শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মাইটোকন্ড্রিয়া | Mitochondria

মাইটোকন্ড্রিয়া (Mitochondria) – The powerhouse of the cell.

কোষ বিভাজনের সময় সৃ্ষ্ট স্পিন্ডল বা মাকুর কাছাকাছি অথবা সাইটোপ্লাজমে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়ানো দ্বিস্তরী পর্দাবেষ্টিত, দন্ডাকার, গোলাকার, বৃত্ত অথবা তারকাকৃতি বদ্ধ থলির মতো শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত সজীব বস্তুগুলোকে মাইটোকন্ড্রিয়া (একবচনে – মাইটোকন্ড্রিয়ন) বলা হয়। কলিকার (Albert von Kolliker) ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সাইটোপ্লাজমে নানা আকৃতির কতগুলো ক্ষুদ্রাঙ্গ আবিষ্কার করেন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে কার্ল বেন্ডা (Carl Benda) এ ক্ষুদ্রাঙ্গগুলোকে “মাইটোকন্ড্রিয়া” নামকরণ করেন। বিভাজনের মাধ্যমে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। কোষে একটি মাত্র মাইটোকন্ড্রিয়ন থাকলে তা কোষ বিভাজনের সময়ই বিভক্ত হয়ে থাকে।

মাইটোকন্ড্রিয়া (Mitochondria) – The powerhouse of the cell.

আয়তন ও সংখ্যাঃ আকারভেদে মাইটোকন্ড্রিয়ার আয়তন বিভিন্ন রকম। বৃত্তাকার মাইটোকন্ড্রিয়ার ব্যাস ০.২ μm থেকে ২ μm। সূত্রাকার মাইটোকন্ড্রিয়ার দৈর্ঘ্য ৪০ μm থেকে ৭০ μm। দন্ডাকার মাইটোকন্ড্রিয়ার দৈর্ঘ্য ৯ μm ও প্রস্থ ০.৫ μm হতে পারে। কোষভেদে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা বিভিন্ন হয়। সাধারণত উদ্ভিদের কোষপ্রতি মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা ৩০০ থেকে ৪০০টি। প্রাণির যকৃত কোষে সহস্রাধিক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। পরিণত লোহিত রক্তকণিকায় মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে না।

গঠনঃ ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দৃষ্ট মাইটোকন্ড্রিয়ায় নিচে বর্ণিত অংশগুলো পাওয়া যায়-

১। আবরণীঃ প্রতিটি মাইটোকন্ড্রিয়ন দুটি ঝিল্লি দিয়ে আবৃত; এদরকে বহিঃ ও আন্তঃ ঝিল্লি বলে। দুই ঝিল্লির মধ্যে ব্যবধান ৬ – ৮ nm; বহিঃ ঝিল্লি খাঁজবিহীন।

২। প্রকোষ্ঠঃ দুই ঝিল্লির মাঝখানে অবস্থিত প্রকোষ্ঠকে বহিঃপ্রকোষ্ঠ বলে যা কো-এনজাইম – A সমৃদ্ধ তরল পদার্থে পূর্ণ থাকে। আন্তঃঝিল্লি বেষ্টিত ভিতরের গহ্বরকে অন্তঃপ্রকোষ্ঠ বলে। এর ভিতর ঘন দানাদার হোমোজেনিয়াস এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ পদার্থ থাকে; যাকে ধাত্র বা ম্যাট্রিক্স বলে।

৩। ক্রিস্টি (Cristae): বাইরের ঝিল্লি সোজা কিন্তু ভিতরের ঝিল্লিটি নির্দিষ্ট ব্যবধানে ভিতরের দিকে ভাজ হয়ে আঙ্গুলের মত প্রবর্ধক বা ক্রিস্টি ‍সৃষ্টি করে। এগুলো মাইটোকন্ড্রিয়ার ধাত্রকে কতকগুলো অসম্পূর্ণ প্রকোষ্ঠে বিভক্ত করে। ক্রিস্টির (একবচনে – ক্রিস্ট) ভিতরকার গহ্বরকে অন্তঃক্রিস্টি গহ্বর বলে যা বহিঃপ্রকোষ্ঠের সাথে যুক্ত।

৪। F0 – F1- দানাঃ মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্রিস্টির গায়ে ক্ষুদ্র টেনিস র‌্যাকেট সদৃশ্য দানাগুলোকে F0 – F1 দানা বলে। এগুলোকে অক্সিজোম (Oxisome) ও বলা হয়। প্রতি দানা একটি মাথা, একটি বৃন্ত এবং একটি পদ নিয়ে গঠিত। দানার মস্তক হলো F1 এবং পদ হচ্ছে F0। এ কারনে বর্তমানে এই দানাগুলো F0 – F1 দানা বা কণা নামে পরিচিত। অক্সিজোম দানাগুলো ATP- এজ (ATP- age) রূপে কাজ করে। শ্বসনের ইলেক্ট্রন পরিবহন  তন্ত্রের (ETS) প্রান্তে H+ অন্তঃপর্দার বাইরে থেকে F0 – F1 দানার মধ্যে দিয়ে মাইটোকন্ড্রিয়ার ধাত্রে আসে। এর ফলে ADP ও iP যুক্ত হয়ে ATP উৎপন্ন হয়। এই কারনে F0 – F1 কে ATP সিন্থেসেস (ATP Syntheses) বলা হয়।

৫। মাইটোকন্ড্রিয়াল DNA: মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরে একটি দ্বিসূত্রক DNA অণু পাওয়া যায়। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য একে মাইটোকন্ড্রিয়াল DNA বলে।

৬। রাইবোজোমঃ মাইটোকন্ড্রিয়ায় এনজাইম সংশ্লেষের জন্য 70s রাইবোজোম পাওয়া যায়। এটি ব্যাকটেরিয়ার রাইবোজোমের অনুরূপ।

রাসায়নিক গঠনঃ মাইটোকন্ড্রিয়ার শুষ্ক ওজনের ৬৫% প্রোটিন, ২৯% গ্লিসারাইডসমূহ, ৪% লেসিথিন ও সেফালিন এবং ২% কোলেস্টেরল। লিপিডের মধ্যে ৯০ ভাগই হচ্ছে ফসফোলিপিড উপাদান, বাকি ১০ ভাগ ফ্যাটি এসিড, ক্যারোটিনয়েড, ভিটামিন-ই ও কিছু অজৈব পদার্থ। মাইটোকন্ড্রিয়ার ঝিল্লি লিপোপ্রোটিন সমৃদ্ধ। মাইটোকন্ড্রিয়ায় প্রায় ১০০ ধরনের এনজাইম ও কো-এনজাইম রয়েছে। এগুলোর প্রায় সবই ম্যাট্রিক্সে এবং দুই ঝিল্লির মধ্যবর্তীস্থানে বিস্তৃত। এছাড়া এতে RNA ও DNA পাওয়া যায়। মাইটোকন্ড্রিয়ার অন্তঃঝিল্লিতে কার্ডিওলিপিন নামক বিশেষ ফসফোলিপিড থাকে।

মাইটোকন্ড্রিয়ার কাজঃ

(১) শ্বসন কাজে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন এনজাইম ও কো-এনজাইম মাইটোকন্ড্রিয়া সরবরাহ করে।

(২) গ্লাইকোলাইসিস ছাড়া শ্বসনের সবকটি বিক্রিয়া (যথা- ক্রেবস চক্র, ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম ইত্যাদি) মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরে সম্পন্ন হয়।

(৩) এরা কোষে লৌহ ও স্টেরয়েড পদার্থের জৈব সংশ্লেষ ঘটায়।

(৪) কোষ শ্বসনের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনের মূল প্রক্রিয়াটি মাইটোকন্ড্রিয়াতে সাধিত হয় বলে একে জীবদেহের শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র (power house) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

(৫) এরা প্রোটিন সংশ্লেষণের ‍প্রয়োজনীয় এনজাইম ধারণ করে।

(৬) মাইটোকন্ড্রিয়ায় বিভিন্ন ধরণের ক্যাটায়ন, যেমন- Ca++, S++, Fe++, Mn++ ইত্যাদি সঞ্চিত থাকে।

(৭) ADP কে ATP- তে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে উচ্চ শক্তি বন্ধনী সৃষ্টি করে নিজের দেহে সঞ্চয় করে রাখে।

(৮) নিজস্ব RNA ও DNA উৎপন্ন করে।

(৯) স্নেহ বিপাকেও মাইটোকন্ড্রিয়া অংশ গ্রহণ করে।

(১০) ডিম্বাণু ও শুক্রাণু গঠনে এর ভূমিকা পালন করে।

মাইটোকন্ড্রিয়ার বহির্গঠন ও অন্তর্গঠনের সাথে এর কাজের আন্তঃসম্পর্ক

মাইটোকন্ড্রিয়ার বাইরের ঝিল্লি মূলত রক্ষণাত্মক ভূমিকা পালন করে। ভিতরের অংশকে রক্ষা করাই এর প্রধান কাজ। বহিঃপর্দায় পোরিন নামে প্রোটিন থাকে যা সাইটোসল (সাইটোপ্লাজমের তরল অংশ) ও মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরে বিভিন্ন বস্তুর যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করে। অন্তঃঝিল্লি থেকে সৃষ্ট ক্রিস্টি- তে ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমের সব উপাদান সজ্জিত থাকে এবং এখানেই শক্তি উৎপন্ন হয়। কাজেই মাইটোকন্ড্রিয়ার অন্তর্গঠন কর্মধায়ক এবং বহির্গঠন রক্ষণাত্মক ও বিভিন্ন বস্তুর যাতায়াত নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন