শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২০

গণিতের প্রাথমিক আলোচনা | Preliminary discussion of mathematics

গণিতের ইতিহাস

গণিত কথাটি এসেছে ‘গণনা করা’ থেকে। কথাটির অর্থ হল ’গণনা-বিজ্ঞান’ অর্থাৎ যে বিশেষ জ্ঞান দ্বারা গণনা করা হয়ে থাকে তাকেই গণিত বলা হয়। কথাটি অনেক দিনের পুরোনো। আর্যদের প্রাচীন শাস্ত্র যে বেদ, সেই বেদেরও বিভিন্ন জায়গায় ‘গণিত’ কথাটির উল্লেখ আছে। বেদের একটি অংশের নাম ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষ’। পণ্ডিতেরা মনে করেন, বেদাঙ্গ রচনা করা হয়েছিল যীশু খৃষ্টের জন্মের অন্তত বারো শ’ বছর বা তারও আগে। প্রাচীন আর্য বা হিন্দুরা গণিতকে বিজ্ঞান হিসেবে যে কত উচু আসন দিয়েছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় বেদাঙ্গের একটি বাক্য থেকে। তাতে লেখা আছে, ময়ূরের মাথায় যেমন শিখা, সাপের মাথায় যেমন মণি, ঠিক সে রকম শাস্ত্রের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো গণিত।
গণিতের ইতিহাস

    এক কথায় ‘গণিত’ বলে প্রকাশ করলেও এর বিভিন্ন বিভাগ সম্বন্ধেও হিন্দু পণ্ডিতেরা বেশ কিছু জানতেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রাদিতে দেখা যায় যে গণিতের রয়েছে তিনটি বিভাগঃ ১. মুদ্রা অর্থাৎ আঙ্গুলের সাহায্যে গণনা করা যায় যে গণিত, ২. গণনা অর্থাৎ মনে মনে হিসেব করে করা যায় যে গণিত, ৩. সংখ্যায়ন অর্থাৎ উচ্চ পর্যায়ের গণিত। অবশ্য সংখ্যায়ন কথাটি গণিতের সব রকম শাখা সম্বন্ধেই ব্যবহার করা চলে। আজকালকার দিনে আমরা গণিত বা অংক বলতে শুধুমাত্র গণনা বা সংখ্যায়ন বুঝিনা, কথাটি আজ আরও ব্যাপক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পাটিগণিত, বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, প্রভৃতি। কিন্তু সেকালে গণিত শাস্ত্রের মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যাকেও ধরা হত। জ্যামিতিও পরবর্তীকালে খাঁটি গণিত শাস্ত্রের আওতা থেকে বেরিয়ে যায়। জ্যামিতির সে সময়ে নাম ছিল ক্ষেত্র-গণিত বা কল্পসূত্র। এ সম্বন্ধে আমরা পরে আলোচনা করব।

    পাটিগণিত, বীজগণিত প্রভৃতির কথা উল্লেখ করলাম; এ নামগুলো কি করে এলো? যে কোন শাখার গণিতের কথা ধরা যাক না কেন, না লিখে কোন গণনাকার্য করা যায় না। অবশ্য আঙুলে গুণে বা মনে মনে হিসেব করে ছোটখাট অংকের সমাধান করা যায় বটে, কিন্তু জটিল কিছু করতে গেলেই তার জন্যে কোন লিখবার সরঞ্জাম দরকার। এ কাজে দুটি জিনিস চাই। এক- যার উপর লেখা হবে; দুই- যা দিয়ে লেখা হবে। যার উপর লেখা সে কাজে বোর্ড বা পাটি ব্যবহার করা চলে; যা দিয়ে লেখা হবে তা কোন খড়িমাটি হতে বাধা নেই। এই ভাবে পাটি বা বোর্ডের উপর লিখে যে গণনাকার্য করা হত তারই নাম দেওয়া হয় পাটিগণিত। সেকালে মাটি বা পাটির উপর বালি বিছিয়েও এ কাজটি সমাধান করা হত। এজন্যই পাটিগণিতের আরেক নাম দেওয়া হয়েছিল ধূলি-কর্ম। অবশ্য এ নামটার তেমন চল নেই, কিন্তু পাটিতে লেখার চল উঠে গেলেও পাটিগণিত নামটি রয়ে গেছে। পাটিগণিত বলতে এখন আমরা বুঝি যে শাস্ত্রের সাহায্যে উচ্চ পর্যায়ের গণনাকার্য করা যায়।

    পাটিগণিত আর বীজগণিতে তফাৎ কি আমরা তা খানিকটা জানি। পাটিগণিতে কতকগুলো সংখ্যা ব্যবহার করার রীতি আছে। কিন্তু বীজগণিতে অজানা সংখ্যা বা বীজ ব্যবহার করা হয় সংখ্যার বদলে। কোনও প্রতীক বা কোন অক্ষর দিয়ে এই অজানা সংখ্যা বা বীজ বোঝানো হয়।
প্রাচীন ভারতের একজন বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ ছিলেন ব্রহ্মগুপ্ত। তিনিই সর্বপ্রথম পাটিগণিত ও বীজগণিতের মধ্যে প্রভেদ করেন। তিনি একটি বিখ্যাত অঙ্কের বই লিখেছিলেন ‘ব্রহ্মস্ফুট-সিদ্ধান্ত’ নাম দিয়ে। এই বইটিতে বীজগণিত সম্বন্ধে যে অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছিলেন সে অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন ‘কুট্টক’। প্রাচীন ভারতের আরও একজন নামকরা গণিতজ্ঞ ব্যক্তি হলেন শ্রীধর আচার্য। তিনিও বীজগণিত এবং পাটিগণিতকে আলাদা আলাদাভাবেই বিচার করেছেন এবং গণিতের এই শাখা ‍দুটি সম্বন্ধে আলাদা আলাদা গ্রন্থ রচনা করেছেন।

   অংকশাস্ত্রের ইংরেজি নাম ম্যাথম্যাটিক্স। কথাটি এসেছে গ্রীক শব্দ ‘ম্যাথিন’ থেকে; এ কথাটির মানে হল শিক্ষা করা। পাটিগণিতের ইংরেজি নাম অ্যারিথম্যাটিক; এ শব্দটি ‘অ্যারিথমোস’ কথার রুপান্তর। অ্যারিথমোস মানে সংখ্যা। জ্যামিতি বা ক্ষেত্রগণিতের ইংরেজি নাম জিওমেট্রি। এ শব্দটি এসেছে পৃথিবী এবং পরিমাপ থেকে। ত্রিভুজের তিনটি কোণ; ত্রিভুজের গুণাগুণ নিয়ে গণিত শাস্ত্রের যে বিভাগটি গড়ে উঠেছে তার সংস্কৃত বা বাংলা নাম ত্রিকোণমিতি। ইংরেজিতেও ‘ট্রাঙ্গেল’(ট্রাই-অ্যাঙ্গেল) অর্থাৎ ত্রিভুজ থেকেই ট্রিগোনোমেট্রি।

   কাজেই দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর যেখানেই গণিতশাস্ত্রের আরম্ভ হয়ে থাকুক না কেন, গণিতশাস্ত্র দুটি মূল ধারণার উপর নির্ভর করেই সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে গণনা করা; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রাচীন কালের লোকের পৃথিবী এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে ধারণা। অবশ্য আজকের দিনে আমরা যে গণিতের বিভিন্ন শাখার সঙ্গে পরিচিত তার মধ্যেও এই দুটি মূল ধারণার প্রভাব পুরোপুরি বর্তমান। তবে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে গণিতের আর একটি নতুন শাখার প্রবর্তন হয়। সেটি হচ্ছে ‘বিশ্লেষণ গণিত’ ‍যাকে ইংরেজিতে বলা হয় অ্যানালিটিক্যাল ম্যাথম্যাটিক্স। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটনের নাম আমরা কম বেশে সবাই জানি। তিনি গণিতশাস্ত্রের নানা আবিষ্কার করে গেছেন। সে ‍যুগের আর একজন গণিতজ্ঞ ছিলেন লিব্নিৎস্। লিব্নিৎস্ এবং নিউটনই হলেন ‘বিশ্লেষণ গণিতের’ প্রবর্তক। কলেজে অংক নিয়ে পড়ার সময় আমাদের ইনটিগ্রাল এবং ডিফারেনসিয়াল ক্যালকুলাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এই ক্যালকুলাস আসলে বিশ্লেষণ গণিতেরই অংশ বিশেষ। কিন্তু আপনারা শুনে অবাক হবেন যে নিউটন এবং লিব্নিৎসেরও বহু আগে, প্রায় তিন-চার শ’ বছর আগে প্রাচীন ভারতেই একজন শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্য এ সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণার প্রবর্তন করেছিলেন। তার আগে কোন দেশের কোন গণিতজ্ঞ এ সম্বন্ধে কোন কাজ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।

বিশুদ্ধ গণিত ও ফলিত গণিত

আজকের দিনের গণিতকে আমরা মোটামুটি দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকি। একটিকে বলি বিশুদ্ধ গণিত, অন্যটিকে ফলিত গণিত। গণিতের যে সব শাখা সম্বন্ধে এতক্ষণ আলোচনা করা হল তা সবই বিশুদ্ধ গণিতের অংশ বিশেষ। গণিতের নানা প্রক্রিয়া অন্যান্য ব্যবহারিক বিজ্ঞানের নানা কাজে লাগে। এর মধ্যে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতি। গণিতের যে যে অংশ এ সবের বিভিন্ন সমাধানের কাজে লাগে তারই নাম ফলিত গণিত।

    গণিতশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখা সম্বন্ধে একটা ধারণা হওয়ার পর আমরা আলোচনা করতে চাই পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন সভ্য সমাজে কিভাবে গণিতের প্রসার এবং প্রচার লাভ করেছে তার উপর। এখানে বলে রাখা ভালো, বিশুদ্ধ গণিতের সবকটি শাখা সম্বন্ধে আলোচনা করলেও ফলিত গণিতের একটিমাত্র শাখা অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যা সম্বন্ধেও আমরা আলোচনা করব। অন্যান্য শাখা, যেমন পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র প্রভৃতি সম্বন্ধেও এ বই-এর অন্যত্র আলোচনা করা হচ্ছে। জ্যোতির্বিদ্যাকেও গণিতের আলোচনার মধ্যে রাখার কিছু কারণ অবশ্যই আছে। পৃথিবীর সবদেশেই গণিতশাস্ত্র প্রসার লাভ করেছে তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করেঃ

  1. কাল গণনা,
  2. বস্তু গণনা ও 
  3. ক্ষেত্র গণনা
      প্রাচী কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কাল গণনা করা হয় আকাশের সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্রের সাহায্যে। কাজেই জ্যোতির্বিদ্যাকে আমরা গণিত থেকে আলাদা করে ভাবতে পারছি না। দ্বিতীয় হচ্ছে বস্তু গণনা। পাটিগণিত, বীজগণিত প্রভৃতি এর মধ্যে পড়ে। আর তৃতীয়, ক্ষেত্র গণনা হচ্ছে আমাদের ক্ষেত্রগণিত বা জ্যামিতি। 


মানুষের মাথায় কি করে অংক এল

    কোন ছাত্রকে যদি জিজ্ঞেস করা যায়, কোন বিষয়টি তোমার সবচেয়ে শক্ত লাগে? তবে সে এক কথায় উত্তর দিবে অংক। সত্যি, অঙ্কের মত বিদঘুটে বিষয় বোধহয় দ্বিতীয়টি আর নেই। শুধু ছাত্রের কথাই বা বা বলি কেন, যে কোনও সাধারণ শিক্ষিত লোককে ঐ প্রশ্ন করলে সম্ভবত একই জবাব মিলবে। তবে এমন দু-চারজন লোকও আছেন যাদের কাছে অংক খারাপ লাগে না, বরঞ্চ তারা উল্টো ওতে আরও আনন্দ পান। আমাদের এই রকম এক পণ্ডিত বন্ধু একবার বলেছিলেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ হচ্ছে প্রত্যহ একটা করে অতি কঠিন অংক কষে সমাধান বের করা। 

     অথচ আপনারা শুনলে হয়তো অবাক হবেন যে, সম্ভবত সভ্য মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানের যতগুলি বিভাগ প্রচলিত আছে অংক অর্থাৎ গণিতই হল তার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো। মানুষ বোধহয় প্রয়োজনের তাগিদেই অঙ্কের বিভিন্ন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছিল। যেমন প্রয়োজনই তাদের দিয়ে আবিষ্কার করিয়েছিল বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার। 

     এই অংকশাস্ত্র বা গণিতের আবিষ্কার হয় কবে? বন্য মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে যখনই বসবাস করতে শুরু করেছে কৃষির আবিষ্কার তখনও হয়নি, বন্য পশু শিকার করে মানুষের চলে ক্ষুন্নিবৃত্তি- তখনই সম্ভবত গণনা করার প্রয়োজন হয়েছিল মানুষের জীবনে। নিজের নিজের গোষ্ঠীর লোকদের হিসেব রাখা বা শিকারের পরিমাণ কতটুকু হল তার মাপ রাখা এই সব থেকেই হয়তো অঙ্কের সূচনা। অবশ্য এ কাজটি সে সময়ে কীভাবে, কোন পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে তারা করত তা আজও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। 

     কিন্তু সে সব পুরোনো কথা থাক, আর একটু পরের যুগে চলে আসি। বিজ্ঞানের যত রকম শাখার সঙ্গে আজ আমাদের পরিচয় হয়েছে অংকশাস্ত্রিই হল তার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান এবং গোড়ার জিনিস- এ কথা বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। কারণ অংকশাস্ত্রের সাহায্য ছাড়া প্রায় কোন বিজ্ঞানই তেমন করে এগিয়ে যেতে পারে না। তা ছাড়া এর চর্চা খুবই সহজ, অর্থাৎ ব্যয়সাধ্য নয়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় গবেষণা করতে হলে প্রায়ই দরকার হয় এক একটি ‍সুসজ্জিত পরীক্ষাগার দরকার হয় দামী দামী সব যন্ত্রপাতির। কিন্তু খুব জটিল অংক নিয়ে গবেষণা করতে হলেও সরঞ্জাম লাগে অতি সামান্য- কিছু কাগজ এবং একটি কলম বা পেন্সিল। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নাম আমরা কম বেশী সবাই জানি। তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল , আপনার ল্যাবরেটরী অর্থাৎ পরীক্ষাগার কোথায়? গবেষণার সাজ-সরঞ্জামই বা কোথায়? তিনি তার মাথায় দুটো টোকা দিয়ে বলেছিলেন, এই আমার ল্যাবরেটরী, আর তার পর হাত দিয়ে একটা কাগজ আর একটা পেন্সিল তুলে নিয়ে বলেছিলেন, এই আমার বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম। আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অংকশাস্ত্রের উপর। আর সত্যি, পৃথিবীর অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বড় বড় পরীক্ষাগারে দামী দামী যন্ত্রপাতি নিয়ে যে সব গবেষণা করেছেন আইনস্টাইন কেবলমাত্র মাথা খাটিয়ে কাগজ আর পেন্সিলে আঁক কেটে অনেক সময় তার চেয়েও অনেক বড় বড় আবিষ্কার করে গেছেন। তাই বোধহয় অংকশাস্ত্রকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘সায়েন্স অব অল সায়েন্সেস’। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন