লেখকের নামঃ কালী প্রসন্ন সিংহ
প্রথম প্রকাশঃ ১৮৬২ সাল
সংস্করণঃ ১ম, ১৪ এপ্রিল ২০০৯
প্রকাশকঃ অ্যাডর্ন পাবলিকেশন
পৃষ্ঠাঃ ১৪৯
মূল্যঃ ২৩০ ৳
ঊনিশ শতকের শুরুতে বাংলা গদ্য প্রকাশিত হয়ে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) এরপর উল্লেখযোগ্য কালীপ্রসন্ন সিংহের (১৮৪০-১৮৭০) ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ (১৮৬২)। বাচনভঙ্গি, রচনারীতি, আঙ্গিক প্রভৃতি দিক থেকে লেখক এ গ্রন্থে নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালী ভাষার ক্রিয়াপদে সাধু ও কথ্যরীতির মিশ্র প্রয়োগরীতি বর্জন করে ভাষাকে আরও স্নিগ্ধ ও শ্রুতিমধুর করেন এবং গ্রন্থে কলকাতার কথ্য ভাষাকে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন।
কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম প্যাঁচার নকশা অত্যন্ত বেদনার সাথে কলকাতার সামাজিক ক্ষতচিহ্নের যথার্থ ছবি ব্যঙ্গাকারে ফুটিয়ে তুলেছেন। মূলত এটি উপন্যাস নয়, সামাজিক সমস্যামূলক ব্যক্তিগত রচনা। তারপরও হুতোম প্যাঁচার নকশা উপন্যাসের মতই সুখপাঠ্য। এর মাধ্যমে কলকাতা ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষাকে প্রথম সাহিত্যে স্থান দেওয়া হয়েছে। হুতোম প্যাঁচার নকশায় কলকাতায় হঠাৎ ফেঁপে ওঠা ঐশ্বর্য ভারাক্রান্ত নব্যসমাজ এবং তার প্রায় সব ধরণের মানুষের চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এ গ্রন্থে যাদের ব্যঙ্গ করা হয়েছে তারা প্রায় সবাই লেখকের স্বশ্রেণির ও তৎকালীন সমাজের অসাধারণ পরিচিত মানুষজন। তারা তিন ভাগে বিভক্ত- সাহেবি ওল্ড অর্থাৎ ইংরেজী শিক্ষিত সাহেবী চালচলনের অন্ধ অনুকরণকারী। নব্যপন্থী যারা অন্ধ অনুকরণকারী নয় এবং ইংরেজী না জানা গোড়া হিন্দু। এরা সকলেই কমবেশি জাল-জুয়াচুরি, ফন্দি ফিকির করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। অনেক অনেক বাস্তব চরিত্রকে হুতোম অঙ্কন করেছিলেন ছদ্মবেশে। সেই সঙ্গে পাতায় পাতায় সেকালের শহরের নানা প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান, যানবাহন ও পল্লীর চিত্রময় বর্ণনা দিয়েছেন। যে বর্ণনায় ছবির মতো ফুটিয়ে তুলেছে নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা।
সমকালের বাস্তব জীবন যেমন, তেমনি জীবনসংলগ্ন ভাষাভঙ্গির জন্য গ্রন্থখানি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। কলকাতা ও তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলের মৌখিক ভাষার প্রথম সুষ্ঠু প্রয়োগ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলা গদ্যে এরকম নিরঙ্কুশ কথ্যরীতির যথার্থ প্রয়োগ ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। লেখক হুতোম ছদ্মনামে লিখতেন বলে এর ভাষা ‘হুতোমী বাংলা বলে পরিচিত’। এর ভাষা প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালী ভাষা থেকে মার্জিততর ও বিশুদ্ধতর। এতে কথ্য ও সাধু ক্রিয়াপদের মিশ্রণ নেই।
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ উপন্যাসের কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়লেও, শিল্প বিচারে একে যথার্থ উপন্যাস বলা চলে না। এতে কোন ধারাবাহিক কাহিনী নেই, কোন চরিত্র মিশ্রণের সচেতন প্রয়াস নেই। সে আমলের কলকাতার কতগুলো সামাজিক চিত্রের ব্যঙ্গাত্মক বর্ণনাই এতে স্থান পেয়েছে। মূলত লেখক এটিকে উপন্যাসের আদলে লেখার আদৌ কোন চেষ্টা করেন নি।
ঊনিশ শতকের কলকাতার বাঙালী সমাজকে জানার অন্যতম প্রধান উপায় হল হুতোমের নকশা। নকশার ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকলেও শ্লীলতার মাত্রা অতিক্রম করেনি। গ্রন্থে উল্লিখিত যে সকল চরিত্র নিন্দা করার মতো নয় লেখক তাদের সঙ সাজিয়ে উপস্থাপন করেছেন। লেখকের সরস উপস্থাপন ঐ সময়ের সমাজের নানা অসঙ্গতিকে পাঠকের সামনে জীবন্ত করে তোলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন