লেখকের নামঃ প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩)
প্রথম প্রকাশঃ ১৮৫৮ সাল
সংস্করণঃ এপ্রিল ২০০৯
প্রকাশকঃ অ্যাডর্ন পাবলিকেশন
পৃষ্ঠাঃ ১৫১
মূল্যঃ ২৩০৳
ঊনিশ শতকের শুরুতে বাংলা ভাষার গদ্যরূপ প্রকাশিত হয়। আরও পরে বাংলা কথাসাহিত্য তথা উপন্যাস শিল্পের বিকাশ। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরসহ খ্যাতিমান লেখকদের সংস্কৃত এবং ইংরেজি ঘেঁষা উচ্চমার্গের সাধু ভঙ্গিতে লেখা গ্রন্থ তখন সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অসম্ভব ছিল। প্যারীচাঁদ মিত্র তখন লেখ্য ও কথারীতির মিলন ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা অবলম্বনে সর্বজনবোধগম্য নবতর এক গদ্যরীতির সূচনা করেন। আর এ রীতি অবলম্বন করে বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য প্যারীচাঁদ মিত্রের (১৮১৪-১৮৮৩) ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) উপন্যাসটির আবির্ভাব। সংস্কৃত এবং ইংরেজ লেখকদের অনুসরন না করে সেকালের কলকাতা অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষাকে বাহন হিসেবে গ্রহণ করে নিজস্ব চিন্তা-চেতনার আলোকে বিষয়বস্তু নির্বাচনের মাধ্যমে রচনা করেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’।
‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রথম গ্রন্থ। ১৮৫৪ সাল থেকে এটি মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। সাহিত্য সমালোচকগণের মতে; এটি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সামাজিক নকশা। গ্রন্থটি সম্পূর্ণ সামাজিক পটভূমিকায় রচিত। নব্যশিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গলদের কার্যকলাপ ও পরিণতি এ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এখানে দেশীয় বন্ধ্যা শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ নিয়ে লেখকের অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার আলোকে উচ্চ আদর্শ সম্পন্ন জীবন গঠনকে লেখক স্বাগত জানিয়েছেন। প্যারীচাঁদ মিত্র এই নবলব্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করেছেন যে ধর্ম ও নীতিহীনতাই উচ্ছৃঙ্খলতার মূল কারণ। সুতরাং ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনযাত্রা প্রণালীর মধ্যেই রয়েছে এ থেকে মুক্তির পথ। এ কথা প্রমাণ করার জন্যই তিনি লিখেছেন আলালের ঘরের দুলাল।
আলালের ঘরের দুলালের কাহিনী এরূপ- ধনী বিষয়ী বাবুরামের অতি আদরের পুত্র মতিলাল আবাল্য কখনও ধর্মীয় ও নীতির শিক্ষা পায় নি। শিক্ষার ব্যাপারেও পিতা ছিলেন উদাসীন। উপরন্তু কুসঙ্গ তাকে অধঃপতনের শেষ ধাপে নিয়ে যায়। পিতার মৃত্যুর পর প্রাপ্ত সব সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলে। পরে দুঃখের জীবনে তার বোধদয় ঘটে এবং হৃদয় মন পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে মতিলালের অনুজ রামলাল আদর্শ চরিত্র। বরদাবাবুর একান্ত স্নেহছায়ায় বড় হয়ে তার সকল নির্দেশ মান্য করে সে সর্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছে। মতিলালের চৈতন্যদয় ও আদর্শ জীবনের প্রতি আকর্ষণের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটেছে উপন্যাসের। মূল ঘটনা অপেক্ষা এ বিচিত্র ক্ষুদ্র পল্লবিত ঘটনাই গ্রন্থটির আশ্চার্য সফলতার কারণ। বস্তুত: বরদাবাবুর মত মূর্তিমান নীতিপাঠ, বেনী বাবুর মত সজ্জন অথবা আদর্শ যুবক রামলাল এরা কেউই আলালের মত মূল আকর্ষণীয় নয়। এদের মধ্যে সুশিক্ষা থাকতে পারে কিন্তু উপন্যাসের যা প্রধানতম উপকরণ জীবনের স্বাদ তা এই চরিত্রগুলোতে নেই। আলালের অবিস্মরণীয় সাফল্য এনে দিয়েছে মতিলাল স্বয়ং এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ হলধর, গদাধর ইত্যাদি। এছাড়াও ধূর্ত উকিল বটলর, ধরিবাজ মুৎসদ্দি বাঞ্ছারাম, তোষামোদকারী বক্রেশ্বর বাবু ইত্যাদি চরিত্র জীবন্ত। তবে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলো মোকাজন মিঞা বা ঠকচাচা। চরিত্রটি ধূর্ততা, বৈষয়িক বুদ্ধি ও প্রাণময়তা নিয়ে এ গ্রন্থের সবচেয়ে জীবন্ত চরিত্র।
আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সমাজের খণ্ডচিত্রগুলো সুনিপুনভাবে অঙ্কিত হয়েছে। যা সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ গ্রন্থে তিনি প্রথমবারের মত বাংলা সাহিত্যের গদ্যরীতির নিয়ম ভেঙ্গে সচেতনভাবে সংস্কৃতের পরিবর্তে চলতি ভায়া প্রয়োগ করেছেন। যা সাধারণ মানুষের ভাষা। এ উদ্যোগটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। এ গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে ‘আলী রীতি’ হিসেবে পরিচিত। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে আর এর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শিল্পনৈপূন্য প্রদর্শনপূর্বক তিনি হয়ে উঠলেন প্রথম সার্থক গদ্যশিল্পী এবং স্বকীয় সত্ত্বার ভাস্বর। আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাস হিসেবে স্বার্থক না হতে পারে কিন্তু এ গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা গদ্য সাহিত্যে এক নতুন পথ সূচিত হয়েছে এবং আধুনিক উপন্যাস রচনার পথ সুগম করে দিয়েছে। আলালী ভাষারীতি বাংলা গদ্যের মাধ্যম হিসেবে টিকতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে যে আদর্শ গদ্যরীতির উদ্ভব ঘটেছিল তার পিছনে এ আলালী রীতির অবদান অনস্বীকার্য। আর এখানেই প্যারীচাঁদ মিত্রের সার্থকতা।
প্যারীচাঁদ মিত্র ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে এ উপন্যাসটি পত্রিকায় লেখেন। আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাস কিনা এ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন এটি বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস, আবার কারো মতে এটি উপন্যাস নয়, উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। আলালের ঘরের দুলাল সার্থক উপন্যাস না হলেও বাংলা ভাষার উপন্যাস রচনার প্লাটফর্মটি তৈরি করে দেয়। এ গ্রন্থটি ‘দি স্পয়েড চাইল্ড’ নামে ইংরেজীতেও অনূদিত হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন