Header Ads

ফ্রীডম্যানের অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব/অর্থের আধুনিক পরিমাণ তত্ত্ব/শিকাগো মতবাদ

ফ্রীডম্যানের অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব/অর্থের আধুনিক পরিমাণ তত্ত্ব/শিকাগো মতবাদ (Friedman’s Quantity Theory of Money/Modern Quantity Theory of Money/Chicago Approach)

আধুনিক অর্থনীতিবিদ Milton Friedman অর্থের পরিমাণ সম্পর্কে যে বক্তব্য প্রদান করেন, তাই সামষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থের আধুনিক পরিমাণ তত্ত্ব নামে পরিচিত। Friedman মূলত অর্থের পরিমাণ সংক্রান্ত Classical বক্তব্যের দোষত্রুটি দূর করে একটি পরিমার্জিত বক্তব্য প্রদান করেছেন যা অর্থের আধুনিক পরিমাণ তত্ত্ব নামে পরিচিত। তাছাড়া Friedman আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, তাই ফ্রীডম্যানের তত্ত্বকে আবার শিকাগো মতবাদও বলা হয়।

Milton Friedman প্রথমে অর্থের চাহিদার নির্ধারকগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি অর্থের যোগানের সাথে দামস্তরের সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবে অর্থের চাহিদা এবং অর্থের যোগানের সমন্বয়ে আধুনিক অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। ফ্রীডম্যানের আধুনিক পরিমাণ তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করা যায় দু’ভাবে। যথাঃ

            ক) অর্থের চাহিদার নির্ধারকসমূহ     এবং    খ) অর্থের যোগান তথা আর্থিক নীতি।

ক) অর্থের চাহিদার নির্ধারক এবং অর্থের চাহিদা অপেক্ষকঃ

অর্থের চাহিদা অনেকগুলো উপাদন দ্বারা প্রভাবিত হলেও Friedman এর মতে, অর্থের চাহিদার প্রধান নির্ধারক চারটি। যথাঃ

            ১। সম্পদ (Wealth)

            ২। সুদ-সুযোগ ব্যয় (Interest – Opportunity Cost)

            ৩। দামস্তরের আপেক্ষিক পরিবর্তন (Relative Change of Price Level) এবং

            ৪। রুচি, পছন্দ ও প্রত্যাশা (Taste, Choice & Expectation)

নিচে অর্থের চাহিদার নির্ধারকগুলো ব্যাখ্যা করা হলোঃ

১। সম্পদ (Wealth): Friedman এর মতে, অর্থের চাহিদা নির্ভর করে বিভিন্ন উপায়ে ধারণকৃত সমাজের মোট সম্পদের উপর। সম্পদ অবশ্যই দুই ধরনের। যথাঃ ক) মানব সম্পদ (Human Wealth) ও খ) বস্তুগত বা অ-মানব সম্পদ (Non - Human Wealth)। মানুষ বিভিন্নভাবে সম্পদ ধারণ করতে পারে যেমন- বন্ড, ইক্যুইটি, নগদ অর্থ, মেধা, কর্মদক্ষতা ইত্যাদি। মোট সম্পদ দ্বারা নগদ অর্থের চাহিদা প্রভাবিত হয়। সমাজের মোট সম্পদ বাড়লে নগদ অর্থের চাহিদা বাড়ে এবং মোট সম্পদ কমলে নগদ অর্থের চাহিদা কমে। অর্থাৎ Friedman তাঁর তত্ত্বে অর্থকে বিনিময়ের মাধ্যম ও সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

২। সুদ-সুযোগ ব্যয় (Interest – Opportunity Cost): নগদ অর্থ ব্যাংকে না রেখে হাতে রাখলে কিছু সুদ প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হতে হয়- একে বলা হয় সুদ সুযোগ ব্যয়। সুদের হার বেশি হলে সুদ সুযোগ ব্যয় বেশি হয় এবং নগদ অর্থের চাহিদা কমে। অন্যদিকে, সুদের হার কম হলে সুদ-সুযোগ ব্যয় কম হয় এবং নগদ অর্থের চাহিদা বেড়ে যায়। অর্থাৎ অর্থের চাহিদা সুদ-সুযোগ ব্যয়ের দ্বারা বিপরীতভাবে প্রভাবিত হয়।

৩। দামস্তরের আপেক্ষিক পরিবর্তন (Relative Change of Price Level): দামস্তরের আপেক্ষিক পরিবর্তনের উপর অর্থের চাহিদা নির্ভর করে। দামস্তর বাড়লে অর্থের চাহিদা বাড়ে এবং দামস্তর কমলে অর্থের চাহিদা কমে। বিষয়টি এ রকম- দামস্তর বাড়লে একই পরিমাণ দ্রব্য ও সেবা কেনার জন্য পূর্বের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ লাগবে, তাই নগদ অর্থের চাহিদা বাড়ে। অন্যদিকে, দামস্তর কমলে একই পরিমাণ দ্রব্য ও সেবা কেনার জন্য পূর্বের চেয়ে কম পরিমাণ অর্থ লাগবে, তাই নগদ অর্থের চাহিদা কমে। এভাবে দামস্তরের আপেক্ষিক পরিবর্তনের সাথে অর্থের চাহিদার সম্পর্ক বিপরীত।

৪। রুচি, পছন্দ ও প্রত্যাশা (Taste, Choice & Expectation): রুচি, পছন্দ ও প্রত্যাশার উপর অর্থের চাহিদা নির্ভর করে। রুচি ও পছন্দ অনুকূল হলে নগদ অর্থের চাহিদা বাড়ে এবং রুচি ও পছন্দ প্রতিকূল হলে নগদ অর্থের চাহিদা কমে। আবার ভবিষ্যতে দাম বৃদ্ধির প্রত্যাশা থাকলে বর্তমানে নগদ অর্থের চাহিদা কমে এবং ভবিষ্যতে মন্দার আশংকা থাকলে বর্তমানে নগদ অর্থের চাহিদা বেশি হয়।

উপরোক্ত নির্ধারকগুলোর উপর ভিত্তি করে Friedman অর্থের চাহিদা অপেক্ষক নির্ধারণ করেছেন। যেমন-

Friedman এর মতে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের  কোন দেশে সাধারণত জনগণের রুচি, পছন্দ ও প্রত্যাশা এবং দামস্তর স্থির থাকে। তাই অর্থের চাহিদা মূলত নির্ভর করে সম্পদ এবং সুদ-সুযোগ ব্যয়ের উপর। তাই অর্থের চাহিদা অপেক্ষক হবে নিম্নরূপ:

Md = f (w, ri,)

তবে সম্পদ বলতে সাধারণত আয়কে বুঝানো হয়। আয় আবার দুই ধরনের স্থায়ী আয় (Yp) এবং অস্থায়ী আয় (Yt)। Friedman এর মতে, দীর্ঘমেয়াদে অস্থায়ী আয় শূণ্য (Y­t=0)। তাই Y=Yp=W। কাজেই

            Md = f (Y, ri)

Friedman এর মতে, অর্থের চাহিদার সুদ স্থিতিস্থাপকতা খুবই নগণ্য। অর্থাৎ অর্থের চাহিদার উপর সুদের হারের প্রভাব খুবই কম। তাই অর্থের চাহিদা প্রধানত নির্ভর করে আয়ের (Y) উপর। সুতরাং অর্থের চাহিদা অপেক্ষক হবে Md = f (Y)। আয় (Y) বাড়লে অর্থের চাহিদা (Md) বাড়ে এবং আয় কমলে অর্থের চাহিদা কমে। নিম্নের চিত্রে আয়ের সাথে অর্থের চাহিদার সম্পর্ক দেখানো হলোঃ

চিত্রের OX অক্ষে আয় এবং OY অক্ষে অর্থের চাহিদা ধরা হয়েছে। আয় যখন OY0 তখন A বিন্দুতে অর্থের চাহিদা AY0। আয় বেড়ে যদি OY1 হয় তবে অর্থের চাহিদা বেড়ে BY1 হয় যা B বিন্দুতে দেখানো হয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে, আয়ের সাথে অর্থের চাহিদার সম্পর্ক ধনাত্মক এবং স্থিতিশীল (Stable)।

খ) অর্থের যোগান তথা আর্থিক নীতি সম্পর্কে Friedman এর বক্তব্যঃ

Friedman এর মতে, অর্থের যোগান তথা আর্থিক নীতি সামষ্টিক অর্থনৈতিক চলকসমূহকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে অর্থের যোগান দ্বারা আয়, উৎপাদন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও দামস্তর প্রভাবিত হয়। তবে অর্থের যোগান দামস্তরকে প্রভাবিত করে। Friedman এর মতে, অর্থের যোগানের পরিবর্তন করা হলে দামস্তরের উঠানামা হবে; দামস্তরের উঠানামা আবার বাণিজ্য চক্রের সৃষ্টি করবে যা অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। সেই অস্থিতিশীল অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হলে আবার অর্থের যোগানের পরিবর্তনের মাধ্যমে দামস্তরকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলেছেন Friedman।

এভাবে Friedman অর্থের চাহিদা ও অর্থের যোগানের সমন্বয় করে বক্তব্য প্রদান করেছেন। তাই Friedman এর বক্তব্য আধুনিক অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব নামে পরিচিত।

সমালোচনা বা সীমাবদ্ধতা (Criticisms)

Milton Friedman এর অর্থের আধুনিক পরিমাণ তত্ত্বের নিম্নোক্ত সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

            ১। Friedman তাঁর তত্ত্বে বলেছেন, অর্থের চাহিদা স্থায়ী আয়ের (Yp) উপর নির্ভরশীল এবং স্থায়ী আয়ের সাথে অর্থের চাহিদার সম্পর্ক স্থিতিশীল। কিন্তু বাস্তবে সময়ের পরিবর্তনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিবর্তনের সাথে সাথে অর্থের চাহিদাও পরিবর্তীত হয়।

            ২। Friedman তাঁর তত্ত্বে অর্থের চাহিদার নির্ধারকগুলো ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু অর্থের যোগানের নির্ধারকসমূহ ব্যাখ্যা করেননি। কাজেই Friedman এর তত্ত্বকে শুধু অর্থের চাহিদা তত্ত্ব বলা যায়; অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব নয়।

            ৩। Friedman এর মতে, অর্থের চাহিদা সমাজের বিভিন্ন উপায়ে ধারণকৃত মোট সম্পদের উপর নির্ভর করে। কিন্তু সম্পদ ধারণের বিভিন্ন উপাদানের সাথে অর্থের চাহিদার সম্পর্ক সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি।

            ৪। Friedman এর তত্ত্বে, দামস্তর, রুচি, পছন্দ ও প্রত্যাশা ইত্যাদি বিষয়কে স্থির ধরা হয়েছে। কিন্তু দামস্তর , রুচি, পছন্দ ও প্রত্যাশা ইত্যাদি বিষয়সমূহ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তীত হয় এবং তার দ্বারা অর্থের চাহিদাও প্রভাবিত হয়।

            ৫। Friedman শুরুতে বলেছেন সুদের হার দ্বারা অর্থের চাহিদা প্রভাবিত হয়। পরবর্তীতে তিনি আবার বলেছেন, অর্থের চাহিদার উপর সুদের হারের প্রভাব নগণ্য। তাঁর এই বক্তব্য নিজেরই বিরোধিতা।

            ৬। Friedman অস্থিতিশীল অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য অর্থের যোগান তথা আর্থিকনীতির ভূমিকার কথা বলেছেন। কিন্তু আর্থিক নীতি এককভাবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে সক্ষম নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে আর্থিক নীতি ও রাজস্বনীতির সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের টেষ্টা করতে হবে। অথচ Friedman এর তত্ত্বে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে রাজস্বনীতিরি ভূমিকা স্বীকার করা হয়নি।

উপরোক্ত সমালোচনাগুলো থাকা সত্ত্বেও Friedman এর তত্ত্বের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কেননা Friedman সর্বপ্রথম অর্থের চাহিদা এবং অর্থের যোগানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে অর্থের পরিমাণ তত্ত্বে আধুনিকতা সূচনা করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.