শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পথের পাঁচালী উপন্যাসের সমালোচনা

পথের পাঁচালী উপন্যাসের সমালোচনা

পথের পাঁচালী

‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের এক অমর সৃষ্টি। বিংশ শতকের প্রথমভাগে সাধারণ ব্যক্তি জীবনের খুটিনাটি বিশ্লেষণ ও প্রকৃতির নিবিড় পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে নিজের অবস্থান সম্পর্কে জানান দেন বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় (১৮৯৪ - ১৯৫০)। উপনিবেশিক শোষণে ক্ষয়প্রাপ্ত ভারতবর্ষের সকলে যখন ব্রিটিশদের মুখাপেক্ষী হওয়ার জন্য সম্পূর্ণভাবে ইংরেজি শিক্ষায় ব্যস্ত, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তখন অন্যদিকে মনোনিবেশ করেন।

পথের পাঁচালী উপন্যাসের সমালোচনা

ভারতবর্ষের সর্বত্র যখন উপনিবেশিক শোষকদের কর্তৃত্ব বিরাজ করছিল তখন তিনি তীব্রভাবে এর বিরোধীতা শুরু করেন। আর এ বিরোধীতা করেন এ দেশের প্রকৃতিমুখী হয়ে। যা শোষক শ্রেণি চাইলেও পরিবর্তন করতে পারবে না। তিনি প্রকৃতির সাথে একান্তভাবে মিশে যেতে চাইলেন। যার ফলস্বরূপ আমরা তার কথাসাহিত্যে প্রকৃতির নিবিড় পরিচয় খুঁজে পাই। আর এই অতিসুন্দর বর্ণনা তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। যা তার ব্যক্তি জীবনকেই প্রতিয়মান করে। ফলাফল স্বরূপ আমরা তার লেখায় তার আত্মজীবনের ছায়া খুঁজে পাই। আত্মজীবনের ছায়ায় ব্যক্তির পারিবারিক জীবন বর্ণনায় ভারতবর্ষের প্রকৃতির সূক্ষ্ম ও অপরূপ বর্ণনা সমৃদ্ধ তার প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯)। আর প্রথম উপন্যাসের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে তিনি তার স্থান পাকাপোক্ত করে নেন। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় “বিচিত্রা” নামক পত্রিকায়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সজনীকান্ত দাসের রঞ্জন প্রকাশনালয়, কলকাতা থেকে।

উপন্যাসটির কাহিনীর পটভূমিতে রয়েছে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিককার বাংলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের অপু ও তার পরিবারের জীবন যাত্রার কথা, যা উপন্যাসটির মূখ্য বিষয়। হরিহর রায় ছিলেন অপুর বাবা এবং তিনি তার পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। পেশায় তিনি একজন পুরোহিত ছিলেন। আয় ছিল অতি সামান্য, যা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে যেত। তিনি লেখাপড়া জানতেন এবং ভালো কিছু করা স্বপ্ন দেখতেন। তিনি যাত্রাপালার কাহিনী লিখে ভালো উপার্জনের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভালো, সৎ ও লাজুক প্রকৃতির মানুষ। ফলস্বরূপ সবাই তাকে সহজেই ঠকাতে পারত। পরিবার যখন তীব্র অর্থ সংকটে তখনও তিনি তার প্রাপ্ত বেতন আদায় করার জন্য নিয়োগকর্তাকে সরাসরি তাগদা দিতে পারতেন না। হরিহর রায়ের স্ত্রীর নাম সর্বজায়া। যিনি তার দুই ছেলে মেয়ে ও দূর সম্পর্কের পিসি শাশুরী ইন্দির ঠাকুরনের দেখাশুনা করতেন। হরিহর ও সর্বজায়া দম্পতির দুই সন্তান দূর্গা ও অপু। অভাবের সংসারে সর্বজায়া  বৃদ্ধ ইন্দির ঠাকুরনের ভাগ বসানোটা ভালোভাবে নিতে পারতেন না। ফলস্বরূপ মাঝে মাঝে ইন্দির ঠাকুরন অন্য আত্মীয়ের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিতেন। অন্যদিকে দূর্গা ছিল অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির, সে অন্যের বাগান থেকে ফলমূল চুরি করে আনে এবং ইন্দির ঠাকুরনের সাথে ভাগাভাগি করে খায়। তখন পরশীরা এসে সর্বজায়ার কাছে দূর্গার নামে চুরির নালিশ দেয় ও সর্বজায়াকে গঞ্জনা দেয়।

দূর্গা ও অপুর মধ্যে খুব মিল ছিল। দূর্গা তার ভাই অপুকে খুব ভালোবাসে কিন্তু মাঝে মাঝে ক্ষেপিয়ে তুলতেও ছাড়ে না। তারা মাঝে মাঝে চুপচাপ গাছের তলায় বসে থাকে, কোনো মিঠাইওয়ালা দেখলে তার পিছে পিছে ঘুরে বেড়ায়, কখনোবা আবার ঘুরে বেড়ানো বায়োস্কোপওয়ালার বায়োস্কোপ দেখে এমনকি যাত্রাপালাও দেখে। সন্ধ্যাবেলায় দূরের ট্রেনের শব্দ শুনে তারা ট্রেন দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। কাউকে কিছু না জানিয়ে ট্রেন দেখার জন্য অনেক দূরে চলে যায়। একদিন তারা দুজনে জঙ্গলের মধ্যে খেলা করতে গিয়ে ইন্দির ঠাকুরনকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। এদিকে গ্রামে কোন ভালো উপার্জনের ব্যবস্থা না থাকায় হরিহর রায় শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তার না থাকার দরুন বাাড়িতে দিন দিন অর্থ সংকট বাড়তেই থাকে। স্ত্রী সর্বজায়া খুব অসহায় বোধ করতে থাকে। বর্ষাকালে একদিন দূর্গা অনেক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধায়। ভালো চিকিৎসা ও ঔষধের অভাবে তার জ্বর ক্রমে বাড়তেই থাকে এবং এক ঝড়ের রাতে দূর্গা মারা যায়। এরপর একদিন হরিহর শহর থেকে ফিরে আসে এবং বারান্দায় সর্বজায়াকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে। এরপর দূর্গার প্রসঙ্গ উঠতেই সর্বজায়া স্বামীর পায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। হরিহর সব বুঝতে পারে এবং ভেঙ্গে পড়ে। এরপর তারা ঠিক করে যে গ্রাম ও পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে জীবিকার জন্য তারা অন্য কোথাও চলে যাবে।

তারা কাশীতে গিয়ে বসবাস শুরু করে। তাদের জীবনে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসতে না আসতেই হরিহর মারা যান। সর্বজায়া মানুষের বাড়িতে রান্না করার কাজ নেন। অপুও আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে এবং তার মনে পড়ে যায় শৈশবের নিশ্চিন্দিপুর গ্রামকে।

এভাবেই সামাজিক চিত্রসৃষ্টি দিয়ে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের আরম্ভ, দূর অতীতের সাথে পল্লী সমাজের জীবনের যোগ দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় উপন্যাসের শুরু করেন। গ্রামীণ সমাজের জীবনযাপন রীতি, আচার-ব্যবহার, পল্লীপথ, বন-বাদাড়, মাঠ-ঘাট, নদী-প্রান্তর, ফুল-পাখি প্রভৃতির যে জীবন্ত ছবি তিনি এঁকেছেন তার স্থান অতুলনীয়। যেসব বিষয়ের মধ্যে দিয়ে পল্লী মানুষের চলাফেরা তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ নিয়ে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি সমৃ্দ্ধ। এখানে প্রকৃতিই শুরু আবার প্রকৃতিই শেষ। গ্রামীন জনপদের স্থিরচিত্র হিসেবে উপন্যাসটি তার অবস্থান জানান দেয়।

কাহিনীর গভীরতার চেয়ে এখানে মূখ্য হয়ে উঠেছে গ্রামীন মানুষের জীবনের বাস্তব চিত্র। যা আমাদের ভাবনার জগতে গভীরভাবে ছাপ ফেলে। লেখক যেভাবে একটি মাত্র ঘটনাকে দিয়ে সমগ্র গ্রামীন জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন তার কোনো তুলনা হতে পারে না। এখানেই একজন সাহিত্যিকের সার্থকতা। লেখকের গভীর অনুভূতি ও কহিনীর পটভূমি যথার্থভাবেই ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটিকে একটি সার্থক উপন্যাসে পরিণত করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন