শেষের কবিতা উপন্যাসের সমালোচনা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিরোনামঃ শেষের কবিতা উপন্যাসের সমালোচনা
উপন্যাসিকঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)
প্রকাশকালঃ ১৯২৯ সাল
বাংলা সাহিত্যের যে ক’জন খ্যতিমান উপন্যাসিক জন্মেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলা উপন্যাস ঊনিশ শতকের মধ্যভাগে প্যারীচাঁদ মিত্রের হাতে জন্মলাভ করলেও তা সার্থক রূপ লাভ করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে এবং আরোও পরে তা বিকাশ ও প্রসার লাভ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য বাংলার ঊনিশ শতকীয় রেনেসাঁসীয় জীবনবোধ, ব্যক্তিস্বতন্ত্রের চেতনা এবং মানুষের আত্মানুসন্ধানের গভীর বিন্যাস। তাঁর রচিত ”শেষের কবিতা” উপন্যাসের মূল উপজীব্য বাংলার নবশিক্ষিত অভিজাত সমাজের জীবনকথা নিয়ে। ”শেষের কবিতা” উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দশম উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯২৮ সালে প্রথম ছাপা হয় প্রবাসী পত্রিকায়।
”শেষের কবিতা” উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অমিত রায়। প্রচন্ড প্রভাবশালী ধনী পরিবারের সন্তান অমিত। বাবা তাকে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেতে পাঠায়। বিলেতে ছাত্র অবস্থাতেই তার ছেলে বন্ধুর চেয়ে মেয়ে বন্ধুর সংখ্যা বেশি ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কেতকী। সে ছিল তার বোনের বান্ধবী। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং অমিত তাকে একটি আংটি উপহার দেয়। ব্যারিস্টারি পড়া শেষে দেশে ফিরে এসে অমিত পেশায় মনোযোগ না দিয়ে বান্ধবীদের নিয়ে কলকাতার পাহাড় পর্বতে ঘুরে বেড়াতে থাকে। মেয়েদের বিষয়ে তার আগ্রহ থাকলেও কোন উৎসাহ ছিল না। অনেকটা বিলেতি ধাঁচের। ধৈয্য ধরে কাউকে সময় দিতে সে অপারগ। মেয়েদের সাথে সম্পর্ক গড়তে ও ভাঙতে তার সময় লাগে না।
অমিত রায় একবার শিলং পাাহাড়ে ঘুরতে যায়। শিলং এ এসে প্রথমে পাহাড়ে একটি গাড়ির সাথে তার ধাক্কা লাগে। ঘটনার সূত্রপাত মূলত সেখানেই। যে গাড়ির সাথে তার ধাক্কা লাগে তাতেই ছিল উপন্যাসের মূল নায়িকা লাবণ্য। লাবণ্যর বাবা অবনীশ দত্ত ছিলেন একজন কলেজের অধ্যক্ষ। অবনীশ দত্ত তার মাতৃহারা একমাত্র মেয়েকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন। উপন্যাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র শোভনলাল। শোভনলাল অবনীশ দত্তের ছাত্র। শোভনলাল এবং লাবণ্য ছিল সমবয়সী। দুজনের মধ্যে বাল্য প্রেম না থাকলেও শোভনলাল লাবণ্যকে ভালোবাসত। লাবণ্য শোভনকে কখনো প্রশয় দেয়নি। ঐ ঘটনার পর অমিতকে মনে ধরে লাবণ্যর। একপর্যায়ে সে অমিতকে ভালোবেসে ফেলে। তাদের প্রেম খুব অল্প সময়ের মধ্যে জমে উঠে। লাবণ্য ছিল বাস্তববাদী এবং সে খুব সহজেই বুঝতে পারে অমিত একেবারে রোমান্টিক জগতের মানুষ। তার সাথে প্রতিদিনের সংসারে হিসেব নিকেশ চলে না। এর মধ্যেই শিলং এ হাজির হয় অমিতের বোনের বান্ধবী এবং অমিতের প্রেমিকা কেতকী। তার হাতে অমিতের দেয়া আংটি। অমিতকে সে নিজের বলে দাবী করে। ভেঙ্গে যায় অমিত-লাবণ্যর বিবাহ আয়োজন। শেষ পর্যন্ত অমিত স্বীকার করে যে, লাবণ্যর সাথে তার প্রেম যেন ঝরণার জলের মতো যা প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য নয়। আর কেতকীর সাথে তার সম্পর্ক ঘড়ায় তোলা জলের মতো, যা প্রতিদিন পান করা যায়।
”শেষের কবিতা” উপন্যাস হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নাম দিয়েছেন “শেষের কবিতা”। উপন্যাসটির যবনিকাপাতও হয়েছে হৃদয়স্পর্শী একটি কবিতা দিয়ে ”কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও”। এ উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাষা, বিষয়বস্তু, ঘটনা পরম্পরায় মধুরতা, অস্থিসন্ধি এবং পাত্র-পাত্রীর সংলাপ সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে কাব্যময়তা। উপন্যাসটির কাহিনী এবং ঘটনার সূত্রপাত প্রেমানুভূতি দিয়ে হলেও এই প্রেমের সিদ্ধান্ত প্রচলিত মানানসিদ্ধ ছিল না। তা ছিল নতুর ধারার সৃষ্টি এবং নতুন ফলাফলের।
উপন্যাসটির কয়েকটি বাক্য আজ প্রবাদে পরিণত হয়েছে। যেমন- ‘ফ্যাশনটা হলো মুখোশ স্টাইলটা হলো মুখশ্রী’, ‘পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু করে’, ‘বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো’. ’ভালোবাসা খানিকটা অত্যাচার চায় অত্যাচার করেও’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের ছবি আকার কালে কথা সাহিত্যের চিত্রধর্মে কিছু কিছু নতুনত্ব দেখা গেছে, যা আগে ঠিক এমনভাবে দেখা যায়নি। কলমের স্বল্প আচড়ে বক্তব্যকে নিশ্চিতভাবে চোখের সামনে সামগ্রী করে তোলার এক বিশেষ ঝোঁক এবং সেই সাথে দক্ষতা চোখে পড়ে। ১৯৪৬ সালে ”শেষের কবিতা” ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় Farewell, My Friend শিরোনামে। ”শেষের কবিতা”য় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ষোলটি কবিতা এবং মোট তিনশত চুরানব্বইটি কাব্যচরণ ব্যবহার করেছেন। এ উপন্যাসে ব্যবহৃত কাব্যচরণ একটি কাব্যগ্রন্থ রচনার জন্যেও যথেষ্ট। তাছাড়া এ উপন্যাসের গদ্যে রয়েছে কাব্যময়তা। তাই একে কাব্য উপন্যাসও বলা হয়ে থাকে।
কোন মন্তব্য নেই