বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৯

মহাস্থানগড় | পুণ্ড্র জনপদের পুরাকথা

বাংলার প্রাচীন জনপদ পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন । ভারতীয় মহাকাব্যগুলোতে বর্ণিত একটি পৌরাণিক রাজ্যের নাম ছিল পুণ্ড্র । প্রাচীনকালে এটি ছিল একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র ।
মহাস্থানগড়

নামকরণের ইতিহাসঃ
পুণ্ড্র জনপদটি পুণ্ড্রবর্ধন বা পৌণ্ড্রবর্ধন নামেও পরিচিত । পুণ্ড্রবর্ধনের নামকরণ করা হয়েছে পুণ্ড্র জনগোষ্ঠীর নামানুসারে । ঐতরেয় ব্রাহ্মণে(খ্রি.পূ. ৮ম শতক) প্রথমবারের মতো উপজাতি গোষ্ঠী হিসেবে পুণ্ড্রের উল্লেখ করা হয়েছে । অন্ধ্র, শবর, পুলিন্দ ও মুতিব জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে পুণ্ড্ররা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে । পুণ্ড্র জাতি ও তাদের আবাসস্থল বৈদিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের বাইরে অবস্থানের কারণে বৈদিক সাহিত্যে তাদের অপবিত্র আখ্যায়িত হয় ।

অবস্থান ও সীমানাঃ
দক্ষিণে পদ্মা, পশ্চিমে গঙ্গা এবং পূর্বে করতোয়া অথবা যমুনা দ্বারা পরিবেষ্টিত । পুণ্ড্রবর্ধন নামে আখ্যায়িত অঞ্চলটি রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর(ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের অন্তর্গত) এবং প্রাচীন বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল । বুধগুপ্তের রাজত্বকালে(আনু. ৪৭৬-৯৪ খ্রি.) দামোদর তাম্রশাসন অনুসারে পুণ্ড্রবর্ধনের উত্তর সীমা ছিল হিমালয়(হিমাবচ্ছিখর) ।

আবিষ্কার ও শনাক্তকরণঃ
কোন একটি জনগোষ্ঠীর নামানুসারে গঠিত পুণ্ড্র ক্রমশই রাষ্ট্রীয় এককে পরিণত হয় । লেখতাত্ত্বিক বিচারে মৌর্য যুগের মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপি করতোয়া নদীর ডান তীরস্থ বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের সাথে পুণ্ড্রনগরের অবস্থান নিশ্চিত করেছে । শ্রীচন্দ্রের ধুল্ল তাম্রশাসনে পুণ্ড্রভুক্ত খদিরবিল্লি অঞ্চলে বল্লিমুন্দ মণ্ডলে একটি ভূমিদানের উল্লেখ আছে । বল্লিমুন্দ ও খদিরবিল্লিকে যথাক্রমে মানিকগঞ্জ জেলার বল্লিসুদ ও খল্লি গ্রামের সাথে শনাক্ত করা হয় । ভাগীরথীর পূর্বাঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধনরূপে উল্লিখিত হলেও এর পশ্চিমাঞ্চল অনুরূপ নামে উল্লিখিত নয় ।

পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তি দ্বারা উত্তরবঙ্গ যে পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত ছিল তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় । বর্মণরাজের একটি লিপিতে কউশম্বি অষ্টগচ্ছ খন্ডলের উল্লেখ আছে । চীনের সাথে মগধের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে পুণ্ড্রবর্ধনের অবস্থান এর গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় । খ্রিস্টীয় ৭ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এ অঞ্চলে আগমনকারী চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর বিবরণ এ অঞ্চলের উন্নতির প্রতি ইঙ্গিত দেয় । হিউয়েন সাং ক-চু-উ-খি-লো থেকে পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করে, গঙ্গা পেরিয়ে পুন-ন-ফ-তন-ন অঞ্চলে পৌঁছান । সেখান থেকে তিনি আরও পূর্বদিকে গমন করেন এবং কামরূপ যাওয়ার পথে এক বিশাল নদী অতিক্রম করেন । সুতরাং কজঙ্গল থেক পুণ্ড্রবর্ধন হয়ে কামরূপ পর্যন্ত একটি পথ ছিল । সুতরাং মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকার সংস্কৃতির বিস্তার ঘটাতে পুণ্ড্রবর্ধনের অবস্থান ছিল খুব অনুকূলে ।

ইতিহাস ও শাসনকালঃ
গুপ্তযুগে পুণ্ড্রবর্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদে পরিণত হয় । উত্তরবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত গুপ্তযুগীয়  লেখতাত্ত্বিক উপাদানসমূহের দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, পুণ্ড্রবর্ধন কয়েকটি অঞ্চল বা জেলায় বিভক্ত ছিল । অঞ্চলগুলো আবার কয়েকটি বীথি ও মণ্ডলে বিভক্ত ছিল । গুপ্ত সম্রাট কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত একজন উপরিক বা প্রাদেশিক শাসনকর্তার উপর ই অঞ্চলের শাসনভার বিরাজমান ছিল । পাল যুগে পুণ্ড্রবর্ধনের প্রাশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় সীমানা প্রসার লাভ করে । পাল, চন্দ্র ও সেন যুগে উত্তরবঙ্গের ভৌগলিক সীমানার অতিক্রান্ত অঞ্চলসমূহ পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত হয় । লঢ়হচন্দের ময়নামতী ও দামোদর দেবের তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, সমতট মণ্ডল পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল । শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রশাসনে পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত শ্রীহট্ট মণ্ডলের আওতাধীন গরল, পোগর ও চন্দ্রপুর অঞ্চলে ভূমিদানের প্রমাণ রয়েছে । অতএব বঙ্গের উত্তরপূর্ব প্রান্তের সিলেট অঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল । পাল-সেন যুগের ভূমিদানের দলিল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ভৌগলিক দিক থেকে পূর্ববঙ্গের প্রায় সমগ্র অঞ্চলের সাথে সমবিস্তৃত বঙ্গ প্রশাসনিক একক পুণ্ড্রবর্ধনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল । পরবর্তীকালে রাঢ় ও দণ্ড অঞ্চলের সমন্বয়ে গঠিত বাংলার পশ্চিমাঞ্চল বাদে প্রায় সমগ্র বাংলা পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রবর্ধনের আয়ত্তে চলে আসে । লেখতাত্ত্বিক সূত্রের তুলনামূলক গবেষণা থেকে এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় । মধ্যযুগে অঞ্চলটি মহাস্থান নামে পরিচিত হয় ।

মহাস্থান বা মহাস্থানগড়ঃ
মহাস্থান বা মহাস্থানগড়ে বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ নগর পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান । স্থানটি বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিমি উত্তরে ঢাকা - রংপুর মহাসড়কের পাশে অবস্থিত । আয়তাকার ধ্বংসস্তূপটি উত্তর দক্ষিণে ১৫০০ মিটার এবং পূর্ব পশ্চিমে ১৪০০ মিটার বিস্তৃত এবং এর চারপাশ নদী সমতল থেকে গড়ে ৬ মিটার উঁচু প্রতিরক্ষা প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত । প্রাচীরের অভ্যন্তরে দক্ষিণ পূর্ব কোণের সবচেয়ে উঁচু স্থানে রয়েছে শাহ সুলতান মাহীসওয়ারের মাজার ও মোঘল সম্রাট ফররুখ সিয়ার নির্মিত একটি মসজিদ । সুরক্ষিত নগরটি উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে একটি গভীর পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল । উত্তর ও পশ্চিম দিকে পরিখা পুরোপুরি এবং দক্ষিণ দিকে আংশিক  পরিদৃষ্ট হয় । পূর্ব দিকে তখন করতোয়া নদী প্রবাহিত ছিল । অনেক পর্যটক ও পণ্ডিত ব্যক্তি, বিশেষত বুকানন হ্যামিল্টন, ও'ডোনেল, ওয়েস্টম্যাকট, বেভারীজ ও স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এ অঞ্চল পরিদর্শন করে তাদের প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করেন। ১৮৭৯ সালে এ ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীন পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ রূপে শনাক্ত করার সম্পূর্ণ কৃতিত্বের একমাত্র দাবিদার স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম। এখানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মীলিপিতে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপিতে পুণ্ড্রনগর উল্লেখ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নগরটি সম্ভবত মৌর্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখানে দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত জনবসতি ছিল। ১৯২৮-২৯ সালে কে.এন দীক্ষিত এর তত্ত্বাবধানে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ কর্তৃক এ স্থানে প্রথম নিয়মানুগ খননকার্য পরিচালিত হয়। এ খনন কাজ তিনটি ঢিবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ ঢিবিগুলো স্থানীয়ভাবে বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা এবং মুনির ঘুন নামে পরিচিত ছিল। এ খননকার্য তিন দশকের জন্য বন্ধ থাকে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে উত্তরদিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীর এলাকা, পরশুরামের প্রাসাদ, মাজার এলাকা, খোদাই পাথর ভিটা, মানকালির কুণ্ড ধাপ এবং অন্যান্য স্থানে পুনরায় খননকার্য শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে এসব উৎখননের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রায় দু'দশক পর ১৯৮৮ সালে খননকার্য পুনরায় শুরু করা হয় এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এ খননকার্য চলতে থাকে। ১৯৯৩ সালের প্রথমদিকে বাংলাদেশি এবং ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকগণ একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন থেকে প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মধ্যভাগ সন্নিহিত স্থানে প্রতিবছর প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কাজ পরিচালিত হতে থাকে। এ সুরক্ষিত নগরের বাহিরে ভাসুবিহার, বিহার ধাপ, মঙ্গলকোট ও গোদাইবাড়িসহ কয়েকটি স্থানে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক খননকার্য পরিচালিত হয়। 

পুণ্ড্রনগরঃ
পুণ্ড্রনগর বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগরকেন্দ্র। এর প্রাচীনত্ব খ্রিষ্টপূর্ব চার শতকের বলে ধরে নেয়া হয়। মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপিতে এ নগরের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় এবং প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে পুণ্ড্র একটি প্রাচীন নগরকেন্দ্র হিসেবে প্রমাণিত হয়। বগুড়া জেলার মহাস্থানে আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করে হয়েছে। এ শনাক্তীকরনের ভিত্তি হচ্ছে উপযুক্ত ব্রাহ্মীলিপি, সাত শতকের চৈনিক পর্যটক ও তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং এর বিবরণ এবং আদি মধ্যযুগের সাহিত্য করতোয়া মাহাত্ম্য। 

সেন আমল পর্যন্ত না হলেও মৌর্য যুগ হতে পাল আমলের শেষ অবধি পুণ্ড্র জনপদের প্রাশাসনিক সদর দপ্তর হিসেবে পুণ্ড্রবর্ধনের গুরুত্ব অব্যাহত ছিল। গুপ্তযুগে বাংলায় এটি ছিল শাসনের কেন্দ্র এবং পুণ্ড্র জনপদের রাজধানী। পুণ্ড্রনগর করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ছিল। পুণ্ড্রনগরের সাথে জল ও স্থল পথে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল এবং সমগ্র প্রাচীন যুগে এটি ব্যবসাবাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ও সমৃদ্ধ ছিল। মুসলিম যুগের প্রথম দিকে বিখ্যাত দরবেশ শাহ সুলতান বলখী মাহীসওয়ার এর বাসস্থান হিসেবে এ নগরের গুরুত্ব অব্যাহত ছিল। শাহ সুলতান বলখী  প্রাচীন নগরের দক্ষিণ পূর্বাংশে তাঁর খানকাহ নির্মাণ করেছিলেন। নগরটি তখন সম্ভবত প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় ছিল। 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই পোস্টে ব্যবহৃত সবগুলো ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন