বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন
পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যাবে যারা তাদের জীবনকালে এত কাজ করে যান যে আমরা অবাক হয়ে যাই। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন তাদের অন্যতম। শুধু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই তিনি যা করে গিয়েছেন তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে তা-ই যথেষ্ট। অথচ সাহিত্য, শিল্প, মুদ্রণ এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রেও তিনি এক উজ্জ্বল মানুষ।
১৭০৬ সালের ১৭ জানুয়ারী বোস্টনে ম্যাসাচুসেটস কলোনিতে জন্মেছিলেন বেঞ্জামিন। বাবা-মা ও সতেরো জন ভাইবোন মিলে তাঁদের ছিল বিশাল পরিবার। আট বছর বয়সে স্কুলে যেতে শুরু করেন বেঞ্জামিন। দু-বছরও কাটল না। কিছুতেই বাবা সংসারের খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। ছেলেকে ডেকে বললেন একদিনঃ ‘লেখাপড়া সবার জন্য নয়। স্কুলে যাবার কি দরকার। চলে এসো। কাজে হাত লাগাও আমার সাথে।’
স্কুলের লেখাপড়ার এখানেই ইতি। বাবার ছিল ছোট একটা মোমবাতি তৈরির কারখানা। সেখানেই ছেলেকে বসিয়ে দিলেন। ছোট্ট ছেলে, যতটা পারে কাজ করে। ফাঁক পেলেই চলে যায় কাছাকাছি সাগরপাড়ে। সাগরের জল দ্যাখে। দেখে তাঁর অনন্ত বিস্তৃতি। হয়তো ভাবে মনে মনে, সাগরের মতোই কি ছড়িয়ে পড়া যায় না?
জেমস নামে তাঁর এক চাচাত ভাই ছিল। বয়সে খানিকটা বড়ই। ওদের ছিল একটা ছাপাখানা। সেখান থেকে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ বের হতো। নাম ছিল ‘দি নিউ ইংল্যান্ড কারেন্ট।’ খোপে খোপে রাখা থাকতো নানা হরফ। তুলে তুলে লাইন সাজাতে হতো। হাতে কালি মাখানো কাউকে ছাপাখানায় দেখতে লাগত বেশ। ইচ্ছে হল বেঞ্জামিনের, তিনিও শিখবেন ছাপাখানার কাজ। দাদাকে অনুনয় করলেন তিনি, একটু কি সুযোগ করে দেবেন? ছোটভাই, কাজ শিখতে চাইছে। ক্ষতি কী? সাবধানে কাজ করার কথা বললেন। বেঞ্জামিন কাজটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তাই খুব কম সময়ে হরফ সাজানোর কাজ শিখে নিলেন। খাবারের পয়সা থেকে দু চার পয়সা করে জমিয়ে, সুযোগ পেলেই নানা বই কিনতেন। নিজেই নিজের শিক্ষক ছিলেন তিনি। অনেক বিষয় এভাবে পড়ে তিনি শিখে নিয়েছিলেন। নিজেকে নিয়ে এভাবে পরখ করার কথা অকপটে বলেছেন তিনি। লিখেছিলেন নিজের প্রায় অবিশ্বাস্য জীবনকথা। এখনও এই বইয়ের কদর রয়েছে নানা দেশে।
ছাপাখানার কথাতেই ফিরে যাই। ভাইদের কাগজ বের হয় সপ্তাহে একবার। ছাপার অক্ষরে লেখা থাকে নানা মানুষের নাম। বড় ইচ্ছে বেঞ্জামিনের, নিজের নামটা যদি ছাপার অক্ষরে লেখা যেত! সে হবার জো-টি নেই! তা ভালো করেই জানেন তিনি। ভাই যদি দেখতে পান যে পুচকে বেঞ্জামিন লেখা দিয়েছে, রেগেমেগে হয়তো ছাপাখানাতে ওর আসাই বন্ধ করে দেবেন।
একটা বুদ্ধি আঁটলেন মনে মনে। নিজে লিখতেন, কাগজে পাঠাতেন মিসেস সাইলেন্স ডগউড ছদ্মনামে। এত ভালো লেখা লিখেছেন একজন মহিলা, না ছাপিয়ে উপায় কী! নিয়মিত ছাপা হতে থাকলো লেখা। পাঠকের চাহিদাও বাড়ল। চিঠিপত্র আসত অনেক। বেঞ্জামিন দুঃখ পাচ্ছিলেন খুব। জেনেশুনে ছদ্মনামে লেখা না হয় এক কথা, কিন্তু গোপন রেখে কতকাল আর করে যাবেন এ কাজ? বয়স আঠারো হয়েছে। সাহস করে ভাইকে বললেন একদিন। ভেবেছিলেন, হয়তো পিঠ চাপড়ে তারিফ করবেন। তার বদলে খেতে হল প্রচণ্ড বকুনি। কেন যে বকুনি খেয়েছিলেন, জীবনের শেষদিনেও তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। রাগ অভিমান তাঁরও কিছু কম নেই। এমুখো আর হলেন না। সোজা ফিলাডেলফিয়ার গিয়ে কয়েকটি ছাপাখানাতে কাজের খোঁজ করলেন।সবাই পরখ করে দেখতে চাইলেন সত্যিই কাজ জানে কিনা ছেলেটা। দেখা গেল, সবাই তাকে কাজ দিতে চাইছেন! এরকম দক্ষ কাউকে পেলে ছেড়ে দেন নাকি কেউ?
বেঞ্জামিনের ইচ্ছে কিন্তু অন্য। নিজেই হতে চান ছাপাখানার মালিক। ছাপাখানা কেনার টাকা কোথায়? আমেরিকাতে তখন ছাপার মেশিন তৈরিও হতো না। কিনতে হলে যেতে হবে বিলেতে। সে সময়ে পেন্সিল্ভেলিয়ার গভর্নর স্যার উইলিয়াম কেইথ। যারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান তাদের টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন তিনি। সোজা তাঁর কাছে গিয়ে হাত পাতলেন বেঞ্জামিন।
পাকা মানুষ স্যার কেইথ। বেঞ্জামিনকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন, এই ছেলে যাবে অনেকদূর। ওকে তিনি টাকা মঞ্জুর করলেন। কিছু টাকা নিয়ে বিলেতে গেলেন বেঞ্জামিন। কেইথ বলেছিলেন বাকি টাকা বিলেতেই পাঠাবেন। কোথায় কী! টাকা আসবার নাম নেই। এমন কোন চেনাজানা লোকও নন বেঞ্জামিন যে, টাকা বাকি রেখে তাঁকে মেশিন দেবেন।
ঠিক করেই নিলেন তিনি বিলেতে থাকবেন কিছুকাল। রোজগার করে পয়সা জমিয়ে মেশিন কিনে তবেই বাড়ি ফিরবেন। মেশিন কিনে ছাড়লেন তিনি। ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে এলেন। ভাইয়ের অপমানের কথা মনে আছে তাঁর। তাই কাগজই ছাপাবেন মনস্থির করলেন। বের করলেন ‘পেন্সিল্ভেনিয়া গেজেট’। কাগজের বাইরেও নানা বই বের করার ভাবনা এল তাঁর মাথায়। সাতাশ বছর বয়সে বের করলেন ‘পুওর রিচারডস আল্মানারক’। কী ছিল এই বইয়ে? সারা বছরের ক্যালেন্ডার। কখন সূর্য উঠবে, কখন পশ্চিমে ডুববে। এছাড়াও ধর্মীয় নানা পবিত্র দিনের কথা উল্লেখ ছিল। এসব বিষয় সাজিয়েও কিছু কিছু ফাঁকা জায়গা পাওয়া যেত। কী করলেন বেঞ্জামিন? ভালো ভালো সবকথা ঐ জায়গাগুলোতে বসিয়ে দিলেন।
‘Honesty is the best policy’, ‘Early to bed and early to rise, make a man healthy and wise’, ‘Never live that till tomorrow which you can do today’, ‘God helps them that helps themselves’ আরও অনেক কথা।
কথাগুলো আমরা সবাই জানি; হয়তো অনেকে জানিনা যে, এগুলো বেঞ্জামিনের লেখা। তিনি নিজেও এসব কথা অক্ষরে অক্ষরে মানতেন। এভাবেই প্রচুর টাকা হল তাঁর। আর টাকার দরকার নেই। তখন তাঁর বয়স বিয়াল্লিশ বছর বয়স।ভাবলেন, বিজ্ঞানের আঙ্গিনায় একবার পা রেখে দেখিই না কেমন হয়! যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। স্থির তড়িৎ বিষয়ে মনোযোগী হলেন। এখানে তাঁর আরও এক অবদানের কথা বলতে হয়। যখন ফিলাডেলফিয়ায় ছিলনে চুপিসারে কজন বন্ধু নিয়ে একটা দল গড়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন, আমেরিকান থিয়সফিকাল সোসাইটি। অক্সফোর্ডে নয় শুধু সারা আমেরিকাতেই এঁদের নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। নতুন নতুন ভাবনার কথা ছড়াতেন এরা। একসময় এরা বলে বসলেন, স্বাধীনতা চাই আমেরিকার। উৎসাহিত হয়েছিলেন অনেকেই। কতকাল আগের কথা! তবু এখনও ফিলাডেলফিয়ার সোসাইটির বাড়িটা মাথা উঁচু করে দারিয়ে আছে। বলছিলাম, স্থির তড়িৎ বিষয়ে তাঁর মনোযোগী হবার কথা। বিজ্ঞানীরা কোথায় চল্লিশের আগেই সব কাজ করে ফেলেন আর তিনি কিনা চল্লিশে এসে কাজ করবেন বলে ভাবছেন! ফরসা আকাশ ছেয়ে হয়তো এসেছে কালমেঘের দল। থেকে থেকে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। এই নিয়ে লিখলেন তিনি ‘দি সিমিলারিটি বিটুইন লাইটনিং অ্যান্ড ইলেক্ট্রিসিটি’। লেখাটি ছাপালেন এবং রয়েল সোসাইটি লেখাটি পড়লেন। মুখ টিপে হেসেছিলেন সবাই। বুড়ো বয়সে বিজ্ঞান করবে লোকটা? তাহলেই হল।
আকাশের বিদ্যুৎ থেকেই যে আলো হয়, পরীক্ষা করে দেখাতে হবে। নইলে লোকে মানবে কেন? বিজ্ঞানে আন্দাজ বলে কিছু নেই। এ কথা বেঞ্জামিন কি আর জানতেন না? একটা দিনের কথা বলছিঃ মেঘলা দিন। বিরাট এক ঘুড়ি বানালেন তিনি। ঘুড়িটাকে উড়িয়ে দিলেন আকাশে। ঘুড়ির তারে একটা চাবি আটকালেন শক্ত করে। ঘুড়ি ওড়াবার তারটি যে জায়গায় ধরতে হচ্ছিল, সেখানে একটা সিল্কের কাপড় জড়িয়ে নিলেন। কেন এরকম আয়োজন? তার বেয়ে যদি বিদ্যুৎ আসে, বেঞ্জামিনের গায়ে সেই বিদ্যুৎ পৌঁছাবে না। সিল্কের কাপড়ে থেকে যাবে। আরও একটা ছোট্ট তারের টুকরো নেওয়া হল। তারটি আনা হল চাবিটার কাছে। দেখা গেল, কাছাকাছি এলেই ফুলকি তৈরি হচ্ছে। আকাশে আলো তৈরি করছে বিদ্যুৎ, সেই আলো তৈরি করছে বিদ্যুৎ, সেই বিদ্যুৎ ঘুড়ির তারে জমেছে অনেক। পরিবাহী কাছে নিলে ঝলসে উঠবেই। থামলেন না বেঞ্জামিন। চাবিটার সাথে একটা তারের টুকরো জড়িয়ে লাইডেন পাত্রের সাথে লাগালেন। লাইডেন হল একধরনের পাত্র যেখানে বিদ্যুৎ জমানো হয়। নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজটা করেছিলেন বেঞ্জামিন। করণ বিদ্যুতের আঘাতে তাঁর মৃত্যুও হতে পারতো।
তড়িৎ নিয়ে আরও কিছু কথা বলেছিলেন তিনি। ইলেকট্রিক ফ্লুইডের ধারণার তিনি পত্তন করেছিলেন। যে কোন জিনিসেই খানিটা ইলেকট্রিক ফ্লুইড থাকে। এমনিতেই ঠিক আছে, কিন্তু ফ্লুইড কম বেশি হলে জিনিসটা তড়িৎ গ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে ফ্লুইড এসে যোগ হলে জিনিসটা হয় পজিটিভ আর ফ্লুইড বেরিয়ে গেলে হয় নেগেটিভ।
একটা ছোট কাচের রড আর সিল্কের একটুকরো কাপড় নিয়ে ঘষলেন খানিকটা সময়। কাচের রডটা পজিটিভ হল। সিল্কের টুকরোটা নেগেটিভ হল। কেউ কেউ বললেন, ঘর্ষণের ব্যাপার এটা । বিদ্যুতের কোন ব্যাপারই নেই এতে। বেঞ্জামিন বললেন, তারা ঠিক বলছেন না, সিল্ক থেকে খানিকটা ইলেকট্রিক ফ্লুইড কাচের রডে গিয়াছে, তাই কাচের রড পজিটিভ হল। সিল্ক হল নেগেটিভ। ফ্লুইড নতুন করে তৈরি হয় না। একটা জিনিস থেকে থেকে অন্য জিনিসে যেতে পারে। আরও একটা পরীক্ষা করেছিলেন বেঞ্জামিন। দুটো ছোট টুল নিলেন তিনি। পায়াগুলোর তলায় কাচের প্লেট দিলেন। টুল দুটো এখন আর মাটির সাথে লেগে নেই। এবার দুজন মানুষকে তিনি দুখানা টুলের উপর দাঁড়াতে বললেন। একটা একটা টুলে পজিটিভ আর অন্য টুলে নেগেটিভ দেওয়া হল। বলা যায়, একটা পজিটিভ মানুষ, আর একটা নেগেটিভ মানুষ তৈরি হল। করমর্দন হল দুজনের। বিদ্যুৎ কোথায় হাওয়া! পজিটিভ আর নেগেটিভ মিলে শূন্য হয়ে গিয়েছে। মাটিতে দারিয়ে কেউ যদি পজিটিভ বা নেগেটিভ মানুষকে ছুতেন, ধাক্কা খেতেই হতো তাঁকে। বড় শহরে আজ দেখা যায় বাড়ির ছাদের উপর বজ্ররক্ষী দাড়িয়ে রয়েছে। কেন? উঁচু বাড়িতে বজ্রপাত হলে ক্ষয়ক্ষতি আটকায়। যদি থাকে একটা সূচিমুখি বজ্রিরক্ষী, সব বিদ্যুৎ টেনে নিয়ে তার দিয়ে সোজা নামিয়ে দেয় মাটির তলায়। বাড়িটার একটুও কিছু হয় না। এই সবই বেঞ্জামিনের অবদান।
তড়িৎ নিয়ে টুকটাক বহু কাজ করেছিলেন বেঞ্জামিন। সব কথা লিখে গিয়েছেন একটা বইয়ে। বইটার নাম “এক্সপেরিমেন্টস অ্যান্ড অবজারভেশন অন ইলেক্ট্রিসিটি মেইড অ্যাট ফিলাডেলফিয়া ইন আমেরিকা”। বইটা এক কথায় অসাধারণ। পৃথিবীতে নানা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এই বইয়ের। কেউ কেউ বলেন, নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া’, কোপার নিকাসের ‘রেভলিউশনস’ ও ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ এর মতোই এই বইটি। বইটিকে বলা হয় তড়িৎ বিজ্ঞানের প্রিন্সিপিয়া। ১৭৫৩ সাল। বেঞ্জামিনের তখন ৪৭ বছয় বয়স। ডাকবিভাগে পোস্টমাস্টার জেনারেল পদে যোগ দিলেন। অবহেলিত একটা বিভাগকে নিজের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে প্রথম সারিতে তুলে এনেছিলেন তিনি। লাভের মুখ দেখেছিল ডাকবিভাগ। ১৮৪৭ সালে আমেরিকার ডাকবিভাগে প্রথম টিকিট চালু হয়। প্রথম টিকিটে তারই প্রতিকৃতি ছাপা হয়।
ছোটবেলার কথা তিনি ভুলে যাননি কখনো, যখন পড়ার ইচ্ছে ভীষণ অথচ বই পেতেন না। বেঞ্জামিন বললেন, সারকুলেটিং লাইব্রেরী হয়ে আপত্তি কোথায়? একজনের বই অন্য কেউ পড়তে পারবেন। এক লাইব্রেরীর বই অন্য লাইব্রেরীতে নেয়া যায় না। সারকুলেটিং লাইব্রেরী হলে সেটাও হবে। অগ্নি নির্বাপক বিভাগ পৃথিবীতে প্রথম তৈরি করেছিলেন বেঞ্জামিন। অগ্নি বিমা তৈরি করেছিলেন যাতে সত্যিই কেউ বিপদে না পড়ে।
১৭৯০ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটেছে।
Source: Internet & News Journal
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন