মহান বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন মনে করতেন, আলোক রশ্মি শুধুই রশ্মি নয়, কণাও। আর আলো যেহেতু কণা, তাই আলো বোধ হয় তাঁর গতি সূত্র মেনে চলে। মেনে চলে মহাকর্ষ তত্ত্বও। নিউটনের আলোর কণা তত্ত্ব বহুদিন পর্যন্ত রাজত্ব করে।
নিউটনের এই মতের সাথে মিল ছিল ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ জন মিশেলের।
১৮৮৩ সাল। ফিলোসফিক্যাল ট্রানজাকশন অব দ্য সোসাইটির পত্রিকায় বৃটিশ জ্যোতির্বিদ জন মিশেল একটি গবেষণাপত্র লেখেন। মিশেল অদ্ভুত এক বস্তুর কথা বলেন সেখানে। ভীষণ ভারী বস্তুটা, আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সেই সঙ্গে যদি ঘনত্বও খুব বেশি হয়, মিশেল বলেন, সেই নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় বল হবে অনেক শক্তিশালী। কতটা শক্তিশালী? সেটা ঠিকঠাক গণনা করে বলতে পারেননি মিশেল। বলেছিলেন, এতটাই বেশি সেই মহাকর্ষ টান, সেখান থেকে আলো পর্যন্ত বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। আর আলোই যদি বেরোতে না পারে, সেই নক্ষত্রকে আমরা কখনোই দেখতে পাব না। কিন্তু মিশেল এই ধারণা কেন করলেন? মিশেলের এই ধারণার পেছনে ছিল নিউটনের আলোর কণাতত্ত্ব।
মিশেলও নিউটনের সাথে একমত ছিলেন। মিশেলের পক্ষে ছিল নিউটনের মুক্তিবেগ। নিউটন বলেছিলেন, পৃথিবী কিংবা সূর্যের মতো ভারী বস্তুগুলো মহাকর্ষ বল দিয়ে ছোট বস্তুগুলোকে নিজের বুকে আটকে রাখে। ছোট বস্তুকে যদি সেই মহাকর্ষ টান এড়িয়ে মহাশূন্যে ছুটে যেতে হয়, তাহলে তাকে পৃথিবীর মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি গতিতে ছুটতে হবে। পৃথিবীর মুক্তিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার(৭ মাইল)। রকেটের বেগ সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটারের বেশি। তাই রকেট পৃথিবীর মহাকর্ষ টান কাটিয়ে মহাকাশে চলে যেতে পারে। মিশেল বলেন, সেই ভারী নক্ষত্রটার ভর এতটাই বেশি হবে, তার মুক্তিবেগ হবে আলোর গতির চেয়ে বেশি। তাই সেটার মহাকর্ষক্ষেত্র থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারবে না। মিশেল সেই ভারী আলোখাদক বস্তুটার নাম দিলেন ডার্ক স্টার বা কালো তারা।
জন মিশেল |
মিশেলের কথায় যুক্তি ছিল। তাই সেই ধারণায় আকৃষ্ট হলেন ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়েরে সাইমন ল্যাপ্লাস। একটা বই প্রকাশ করেন তিনি। নাম সিস্টেম অব দ্য ওয়ার্ল্ড। সেই বইয়ে ল্যাপ্লাস অঙ্ক কষে মিশেলের কৃষ্ণতারার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব আর মুক্তিবেগের সূত্র ধরেই ছিল তাঁর সব প্রচেষ্টা। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সমান ঘনত্বের একটা নক্ষত্র, কিন্তু তার ব্যাস সূর্যের ব্যাসের ২৫০ গুণ। তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হবে বিরাট। সেটা এতই বেশি, তা থেকে আলো বেরিয়ে আসতে পারবে না।
মিশেলের কথায় যুক্তি ছিল। তাই সেই ধারণায় আকৃষ্ট হলেন ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়েরে সাইমন ল্যাপ্লাস। ১৭৮৫ সালে একটা বই প্রকাশ করেন তিনি। নাম সিস্টেম অব দ্য ওয়ার্ল্ড। সেই বইয়ে ল্যাপ্লাস অঙ্ক কষে মিশেলের কৃষ্ণতারার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব আর মুক্তিবেগের সূত্র ধরেই ছিল তাঁর সব প্রচেষ্টা।
পিয়েরে সাইমন ল্যাপ্লাস |
তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সমান ঘনত্বের একটা নক্ষত্র, কিন্তু তার ব্যাস সূর্যের ব্যাসের ২৫০ গুণ। তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হবে বিরাট। সেটা এতই বেশি, তা থেকে আলো বেরিয়ে আসতে পারবে না। ল্যাপ্লাস তাই আশঙ্কা করেছিলেন, মহাবিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটাকে আমরা কোনও দিনই দেখতে পাবো না! তাঁর মতে সবকিছু গিলে নেওয়া ওই নক্ষত্রটাই সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। এ একথাটা কিন্তু আজও সত্যি।
নিউটন বলেছিলেন, আলো এক ধরনের কণা। আবার জার্মান বিজ্ঞানী হাাইগেনস বলেন, আলো তরঙ্গ। পরে প্রমাণ হয়, আলোর কণা ও তরঙ্গ দুই ধর্মই মেনে চলে। আলোর কণাকে বলে ফোটন। আইনস্টাইন দেখালেন, আলোর কণা ভরহীন (স্থিরভর)। আরও দেখালেন, আলোর কণাকে কখনও থামানো যাবে না। ভরযুক্ত কোনও বস্তুর বেগই আলোর বেগের সমান হতে পারে না। অথচ ব্ল্যাকহোল সেই আলোকে পর্যন্ত গ্রাস করে নেয়!
কথা হচ্ছে, যে জিনিসে আলো রেহায় পায় না, সে জিনিস দেখা যাবে কী করে? কোনও বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখের রেটিনায় আঘাত করে, তখন আমরা সেই বস্তুকে দেখতে পাই।
কিছু জিনিস নিজেরাই আলোর উৎস। যেমন একটা আগুনের কুণ্ডলি কিংবা আমাদের সূর্য। ওদের থেকে আলো সরাসরি আমাদের চোখে এসে পড়ে তাই আগুনের কুণ্ডলি কিংবা সূর্যকে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু ব্ল্যাকহোল থেকে আলো বেরিয়েও আসে না আবার আলো প্রতিফলিতও হয় না। তাই ওকে দেখা যায় না।
তবে ল্যাপ্লাসের কল্পিত ওই উজ্জ্বল নক্ষত্রের সাথে আমাদের এখনকার ব্ল্যাকহোলের ফারাক বিস্তর। ব্ল্যাকহোল হতে হলে কোনও বস্তুকে পৃথিবীর ঘনত্বের হলে চলবে না। সূর্যের চেয়েও অনেক অনেক বেশি ঘনত্ব ব্ল্যাকহোলের। সূর্যের চেয়ে ২৫০ গুণ বেশি ব্যাস হতে হবে, আধুনিক ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। ল্যাপ্লাসের কল্পিত নক্ষত্রকে তাই কিছুতই ব্ল্যাকহোল বলা চলো না। ল্যাপ্লাসের পরেই শুরু ডার্ক স্টারের অন্ধকার যুগ।
১৬৬৫ সাল। ব্রিটেনে তখন প্লেগের মহামারী। কাতারে কাতারে লোক মরছে। ভয়ার্ত মানুষগুলো আতঙ্কে দিশেহারা। প্রাণভয়ে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। ব্রিটেনের ক্যামব্রিজেও লেগেছে মহামারীর বাতাস। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ বিজ্ঞানীও ভীত। ক্যামব্রিজ ছেড়ে চলে গেলেন লিঙ্কনশায়ারের খামারবাড়িতে। সেখানে তাঁর মা আর সৎ বাবা বসবাস করেন। সেই গ্রীষ্মটাই মোড় ঘুরিয়ে দেয় পদার্থবিজ্ঞান ইতিহাসের। এটা নিয়ে প্রায় রূপকথার মতো একটা গল্পও চালু হয়েছে মানুষের মুখে মুখে। আপেল পড়ার গল্প। নিউটন একদিন আত্মমগ্ন হয়ে বসে ছিলেন একটা আপলে গাছের নিচে। হঠাৎ একটা আপেল গাছ থেকে পড়ে মাটিতে। নিউটনের মাথায় তখন একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়। আপেলটা মাটিতে পড়ল কেন? কেন ওপরে উঠে গেল না? তাহলে কি পৃথিবীকে আকর্ষণ করছে?
নিউটন |
রোমান্টিকদের বিশ্বাস সেদিনের সেই আপেল পড়ার ঘটনাই মহাকর্ষ বলের হদিস পাইয়ে দেয় নিউটনকে। এ গল্প সত্যি কি মিথ্যা, নিশ্চিত করে বলার জো নেই। সত্যি হতেও পারে। তবে স্রেফ একটা আপেল পড়ার ঘটনা থেকে মহাকর্ষ বলের জন্ম, একথা বিশ্বাস করা কঠিন। নিউটন অনেক দিন থেকেই মহাকর্ষ বল নিয়ে ভাবছিলেন। হাতড়াচ্ছিলেন কীভাবে এই রহস্য সমাধান করা যায়। লিঙ্কনশায়ারের সেই আপেল পড়ার ঘটনা হয়তো নিউটনের ভাবনার জগতে গতি এনে দিয়েছিল। কিন্তু শুধু সেই ঘটনার কারণেই মহাকর্ষ সূত্র আবিষ্কার হয়নি এটা সত্যি। কারণ মহাকর্ষ বল নিয়ে নিউটনের আগে অনেক বিজ্ঞানীই ভেবেছেন। যদিও তাঁরা সমাধান বের করতে পারেননি।
মহাকর্ষ বলটা কী? আমরা যে পৃথিবীর ওপর হাঁটছি, ঘুরছি-ফিরছি পৃথিবীর বুক থেকে অনন্ত মহাশূন্যে পড়ে যাচ্ছি না, সেটা মহাকর্ষ বলের কারণেই। আবার ওই যে পড়ে যাবার কথা বললাম, সেটাই বা কেমন? গাছের আপেল মাটিতে কেন পড়ে? কেন কোনো কিছু ওপরে ছুড়ে মারলে তা আবার নিচে ফিরে আসে, মাটিতে আছাড় খায়? এর পেছনে একটাই বল কাজ করছে। মহাকর্ষ বল। অনন্ত মহাবিশ্বে আমরা পড়ছি না, কারণ পৃথিবী তার আকর্ষণ শক্তি দিয়ে আমাদের ধরে রেখেছে। আবা মহাশূন্যে বিশাল বিশাল অঞ্চল ফাঁকা। একদম কিছুই নেই। কী পরিমাণ ফাঁকা সেটা কল্পনাও করতে পারবেন না। ফাঁকা বলে সেখানে মহকর্ষ বলের কারসাজিও কম। তাই সেখানে পড়াপড়ির বিষয়টা কল্পনাও করা যায় না। তাহলে আমরা পৃথিবীর বুক থেক মহাশূন্যে পড়ছি না একই সাথে দুটো কারণে। পৃথিবী তার মহাকর্ষ টানের সাহায্যে আমাদের ধরে রেখেছে। আর মহাশূন্যের ফাঁকা অঞ্চলে আকর্ষণ করার মতো কিছু নেই যে আমারা মহশূন্যে কোনো এক দিকে ঝাঁপ দিলেই সেদিকে ভীমবেগে পড়ে যাব।
নিউটন মহাশূন্য বলটা একেবারে খাতা-কলমে প্রমাণ করেছেন। তাই বলে কি প্রাচীনকালের মানুষ মহাকর্ষ বলের কোনো হদিস জানত না। জানত এক প্রকার। সেটাকে আসলে মহাকর্ষ বললে মশকরা করা হবে। প্রাচীন গ্রিসেই আধুনিক সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ শুরু হয়। গ্রিক পণ্ডিত মনে করতেন বস্তুর মাটিতে পড়ার পেছনে স্বর্গীয় ব্যাপার-স্যাপার জড়িয়ে আছে। যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয়, সেসব বস্তু ওপরে নিক্ষেপ করলে আবার মাটিতে ফিরে আসবে। যেসব বিষয়গুলো মানুষ ব্যাখ্যা করতে পারত না, সেখানেই হাজির হতো দেবতা, শয়তান, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি অলৌকিক বিষয়। গ্রিক দার্শনিকদের কাছে বস্তু কেন মাটিতে পড়ে তার ব্যখ্যা ছিল না। তেমনি যেসব বস্তু ওপরে উঠে যায়, তার কারণও তাঁদের জানা ছিল না। আদিম যুগে মানুষ আগুন দেখে ভয় পেত। দিশেহারা হয়ে পড়ত বনের দাবানলে। আগুনের কাছে একদম অসহায় ছিল সেই মানুষগুলো। তাই আগুনকে পুজো করত আদিম যুগের মানুষেরা। অনেক পরে মানুষ আগুনের ব্যবহার শেখে। তখন দেবতার আসন হারায় আগুন। অবশ্য এই আধুনিক যুগেও কোনো কোনো সমাজে আগ্নিপুজো করা হয়ে। তবে তাদের সংখ্যা নগন্য, তারা ব্যতিক্রম।
গ্রিক যুগেও এমন বহু বহু বিষয়কে অলৌকিক মনে করা হত। যেমন আগুন ওপরে উঠে যায় কেন? ওপরে উঠে যায় জলীয় বাষ্প, ধোঁয়া, বিভিন্ন প্রকার গ্যাস ইত্যাদি। এর ব্যাখ্যা গ্রিক দার্শনিকদের কাছে ছিল না। তাই এগুলোর সাথে স্বর্গের যোগ আছে বলে মনে করতেন। তাই এরা স্বর্গের টানে ওপরে উঠে যায়।
আকাশের জ্যোতিষ্কমণ্ডলি দেখা যায় খোলা চোখেই। কত কত তারা আকাশে। একই তারা নিয়ে একেক দেশে একেক গল্প চালু আছে। তারাদেরও নামও আলাদা। একই তারা কোনো দেশে দয়াময় দেবতা, কোনো দেশে আবার ভয়ঙ্কর দানব। কেন এমন হলো? এর পেছনরে কারণ দেশটির ভৌগলিক অবস্থান। কালপুরুষ যখন আকাশের গায়ে ঝলমল করে তখন হয়তো কোনো দেশে সবুজ ফসলে ভরে ওঠে। আবার একই সময়ে কোনো দেশ হয়তো তলিয়ে যায় বানের জলে, কোনো দেশ হয়তো ভয়ঙ্কর খরায় পুড়ে ছারখার। যে দেশ সবুজ ফসলে ভরে ওঠে, সেই দেশ হয়তো কালপুরুষ দয়াময় দেবতা হিসেবে গণ্য হয়। বন্যা কিংবা খরা কবলিত দেশগুলোতে কালপুরুষকে দেখা হয় ভয়ঙ্কর দানবরূপে। এভাবেই হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠে পৌরণিক কাহিনিগুলো। সেসব কাহিনির নায়ক-নায়িকা, ভিলেন, দানব, রাক্ষস, দেব-দেবী সব চরিত্রগুলোই গড়ে উঠেছে কোনো না কোনো তারাকে ঘিরে। সমাজের সুখ-দুঃথ, হাসি-কান্না, বন্যা, মহামারি জড়িয়ে আছে সেসব কাহিনির আড়ালে। মানুষ নিজে যা করতে পারে না, সেই অসম্ভব কাজগুলো করিয়ে নেই কল্পকাহিনির চরিত্রগুলো দিয়ে। এভাবেই সেসব চরিত্র মিশে যায় মানুষের দৈননন্দিন জীবনে। আর সেই কল্প কাহিনির চরিত্রগুলো খুঁজে নেয় রাতের আকাশে, কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্রের ভিড় থেকে।
প্রাচীন যুগেই জন্ম পুরাণ কাহিনিগুলো। তখনই সুত্রপাত জ্যোতির্বিদ্যার। মানুষ আকাশের তারা দেখে পথ চিনতে, চাষ-বাসের সঠিক সময় নির্ধারণ করতে শেখে। সেকালে তাঁরা দেখে কিছু মানুষ ভবিষ্যৎ বলতে পারত। তাদের বলা হত গণক ঠাকুর কিংবা জ্যোতিষ। এর বেশিরভাগ বুজরুকি। তবে কিছু কিছু বিষয় হয়তো ফলে যেত। তবে সেটা মোটেও ভাগ্য গণনা করে নয়। গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথ বিশ্লেষণ করে কিছু মানুষ পেয়ে যেত আবহাওয়ার আগাম সংবাদ। কৃষিনির্ভর সেই সমাজে আগাম আবহাওয়ার সংবাদ জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সেকালে গ্রিসে পৃথিবীকে সমতল মনে করত মানুষ। তখন স্বাভাবিকভাবেই উপর-নিচ-এর ধারণাটা ছিল পরম। তখন মনে করা হতো যেসব বস্তু বা প্রাণী স্বর্গীয় তাদের অবস্থান উপরে, স্বর্গপুরিতে। যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয় তাদের অবস্থান মাটিতে কিংবা পাতালপুরিতে। যেসব বস্তু স্বর্গীয় নয় সেগুলোকে ওপর দিকে ছুঁড়ে মারলে একটা সময় আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। তারপর এক সময় প্রমাণ হলো পৃথিবী সমতল নয়, গোলাকার। তখন উপর-নিচের অগের তত্ত্ব ভেঙে পড়ল। তাই পড়ন্ত বস্তু সম্পর্কে আগের ধারণা আর টিকল না। বস্তু কেন ওপর দিকে ছুঁড়ে মারলে তা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে তার নতুন সমাধান দরকার হয়ে পড়ল।
টলেমী |
সেই সময় এরিস্টটল কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে একটি ব্যাখ্যা দাড় করালেন। তিনি এই পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র বানালেন। তিনি বোঝাতে চাইলেন যে, সূর্য সহ সকল গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তাঁর মতে, সকল বস্তুর গতি পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। তাই কোন বস্তুকে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলে তা আবার পৃথিবীতেই ফিরে আসে। সে সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানে অ্যারিস্টোটলের প্রভাব ব্যাপক। সবাই তাঁর কথা মেনে নিলেন। কিছুকাল পরে খ্রিস্টীয় ১ম শতকে টলেমী নামের এক দার্শনিক এই মহাবিশ্বের একটা মডেল প্রস্তুত করলেন। তা এরিস্টটলের মতের সাথে মিল রেখেই। তিনি তাঁর মডেলকে বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেন। সবার কেন্দ্রে রইল পৃথিবী। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে যথাক্রমে চাঁদ, শুক্র, সূর্য ও মঙ্গল। এরা সবাই একই সরলরেখার অবস্থান করছে। বাকি গ্রহগুলো তখনো আবিষ্কার হয়নি। সেজন্য সেগুলোর স্থান হয়নি সেই মডেলে। একবারে বাইরের স্তরে পৃথিবীর চারপাশে ঘিরে আছে আকাশের অন্য তারাগুলো। টলেমির সেই মডেল দেখে এখনকার প্রথম শেণি পড়ুয়া একটা বাচ্চাও হাসবে। কিন্তু সেকালে গোটা পৃথিবীর লোক সেই মডেল মেনে নিয়েছিল।
১৬শ শতাব্দীতে এসে বাঁধল গোল। পোলিশ জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপর্নিকাস বললেন, অ্যারিস্টোটলের মতবাদ ভুল। তিনি বললেন, সূর্য নয়, বরং পৃথিবী সহ বাকি গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এই বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ তিনি একটি বই লিখলেন। আর এই বইটি ছাপা হলো তাঁর মৃত্যুর আগমুহূর্তে। কিন্তু তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। টাইকো ব্রাহে ছিলেন প্রাগের সম্রাট দ্বিতীয় রোদলফের গণিতজ্ঞ। সম্রাটের রাজ জ্যোতিষিও। তিনি মহাকাশের তারাদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। টাইকোর সহকারী ছিলেন জোহান কেপালার। টাইকোর মৃত্যুর পরে তাঁকেই বসানো হয় স¤্রাটের গণিতজ্ঞ ও প্রধান রাজ জ্যোতিষির পদে। সেকালে রাজ জ্যোতিষির প্রধান কাজই হলো সম্রাটের ভাগ্যের ভবিষ্যদ্বাণী করা, তারাদের গতিপথ দেখে রাজ্যের ভালোমন্দের আগাম খবর জানানো। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে দেশে এসব রাজ জ্যোতিষিরাই ছিল রাজা-বাদশাহদের প্রধান মন্ত্রণাদাতা। তাঁরা বুজরুকি করে রাজাদের ভুল পথে চালাতেন। প্রজাদের ওপর অবর্ণনীয় নীপিড়ন নেমে আসত এসব রাজ জ্যোতিষিদের বুজুরুকির কারণে।
কেপলার ছিলেন একদম আলাদা। ভবিষ্যৎ গণনায় একদম আগ্রহ ছিলনা তাঁর। তবুও সম্রাটের অনুরোধে কিছু কিছু গণানা করতেন। তবে তিনি স্বীকার করতেন এসবে কোনো অলৌকিকতা নেই। আবহাওয়ার মেজাজ-মর্জি বুঝেই করতেন কিছু কিছু ভবিষ্যদ্বাণী। রাজাকে বলতেন এরজন্য জ্যোতিষ হওয়ার দরকার নেই। একটু জ্ঞান থাকলে যে কেউই এ কাজ করতে পারে। রাজা রোদলফও কেপলারকে পীড়াপিড়ি করতেন না। কেপলার তাঁর শিক্ষক ছিলেন। যথেষ্ঠ সম্মান করতেন তিনি কেপলারকে। কেপলার কোপার্নিকাসের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। সেটা ক্যাথোলিক ধর্মমতের বিরোধি। তবু রাজা রোদালফ তাঁকে বাঁধা দেননি গবেষণায়। রোদলফ অন্ধ ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন না। রাজ গণিতজ্ঞের পদে বসিয়ে কেপলারকে তিনি জ্ঞানচর্চার প্রসারেই কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কেপলারের স্বাধীনতা ছিল, তিনি জ্যোর্তিবদ্যার চর্চা করতেন। গ্রহ-নক্ষত্রদের চলার পথ নিয়েও করেছিলেন গবেষণা। কিন্তু তাঁর হাতে ভালো কোনো টেলিস্কোপ ছিল না।
সেই সময় ইতালিতে গ্যালিলিওর ব্যাপক নামডাক। নানা রকম যন্ত্রপাতি তৈরি করে তিনি সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ছিল টেলিস্কোপ। এর আগেও টেলিস্কোপ ছিল না তা নয়। তবে গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের ধারেকাছেও ছিল না আর কারও টেলিস্কোপ। গ্যালিলিও টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আকাশ দেখেন। তারপর ঘোষণা করেন কোপার্নিকাসই ঠিক। কেপলারের মতো অতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না গ্যালিলিও। প্রাগের সম্রাটের মতো রোমান সম্রাট অতটা মহানুভব ছিলেন না। তাছাড়া রোমের ভেতরেই তো পোপোর ভ্যাটিকান। তাঁদের কথাই ইতালি তথা ইউরোপে দৈব বাণী। ভ্যাটিক্যানের বিরোধিতা করে এমন বুকের পাটা ইতালিতে কারও ছিল না। খ্রিস্টান ধর্ম আসলে অ্যারিস্টোটলের মতের বাইরে যেতে পারেনি। এজন্য তাঁকে অবর্নণীয় নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিল। এরপর কেপলার দেখালেন কীভাবে, কোন পথে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলো ঘুরছে। তিনি গ্রহগুলোর চলার পথের জন্য গাণিতিক সূত্রও আবিষ্কার করলেন।
কেনই বা সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো ঘুরছে। কেন ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে না অনন্ত মহাকাশের দিকে? এ প্রশ্নের সমাধান তিনি দিতে পারলেন না। সমাধান এলো সপ্তদশ শতাব্দীতে। নিউটনের হাত ধরে।
নিউটন মহাকর্ষ বলের জন্য একটা সূত্র দিলেন। সেটা হলো, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ বলের মান তত বেশি হবে যত বস্তুদুটোর ভর বেশি হবে। যেকোনো একটার ভর বাড়লেও মহাকর্ষ বলের মান বাড়ে। কিন্তু বস্তু দুটোর মধ্যে দূত্ব যত বাড়ে তাদের মধ্যে মহাকর্ষীয় টান তত কমে। এই কমা আবার সহজ-সরল ভাবে কমা নয়, বর্গাকারে। অর্থাৎ দূরত্ব যদি বেড়ে দ্বিগুণ হয় তবে মহকর্ষ বলের মান কমে আগের মানের এক চতুর্থাংশে নেমে আসবে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, অভিকর্ষ গ্রহসমূহের গতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে, কিন্তু এটি ব্যাখ্যা করতে পারেনা, কে গ্রহগুলোকে গতিশীল হিসেবে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করে দিলে। ঈশ্বর সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যা কিছু ঘটছে বা যা কিছু ঘটা সম্ভব তার সবই তিনি জানেন।
পৃথিবীতে আমরা হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছি, কোনও বস্তু ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ছিটকে মূহশূন্যে চলে যাচ্ছ না, এর কারণও ওই মহাকর্ষ বল। নিউটন দেখালেন মহাকর্ষ বল শুধু আকর্ষণই করে, বিকর্ষণ করে না কখনও।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারী বস্তুর মহাকর্ষীয় প্রভাব কতদূর পর্যন্ত কাজ করে?
নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বলে এর প্রভাব অসীম পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু এটাও ঠিক এই বল খুবই দুর্বল। মহাবিশ্বে, পৃথিবীতে মহাকর্ষ বল ছাড়াও আরও তিন রকম বলের হদিস বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, সবল নিউক্লিয় বল আর দুর্বল নিউক্লিয় বল।
কোন বস্তুর মহাকর্ষ ক্ষেত্রের তার ভরের উপর নির্ভর করে। যেমন, সূর্যের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের সীমা পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি। আবার বুধ গ্রহের মহাকর্ষ সীমা পৃথিবীর থেকে অনেক কম।
আরেকটি সত্যি হচ্ছে, এই মহকর্ষ ক্ষেত্রের ভেতর থেকে কোনো হালকা বা গতিশীল বস্তুও বেরিয়ে যেতে পারে না। যেমন পারে না বায়ুমণ্ডলও।
বায়ুমণ্ডলের গ্যাসীয় পদার্থগুলো পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্রের বাইরে যেতে পারেনা। কারণ, পৃথিবী মহাকর্ষ বল দ্বারা গ্যাসের প্রতিটি পরমাণুকে নিজের দিকে টানছে। অনেকে হয়তো পালটা যুক্তি দেখাবেন। বলবেন, মহাকর্ষ বলই যদি গ্যাসীয় পদার্থের পরমাণু বা অণুগুলোকে আকর্ষণ করে রাখে তবে তাদের কেন এত ওপরে ওঠার প্রবণতা?
একটা কথা বোধহয় কারো অজনা নয়, কঠিন পদার্থের ভেতর অণু-পরামণুগুলো বেশ শক্তিশালী রাসায়নিক বন্ধনের কারণে গায়ে গায়ে লেগে থাকে। এদের অণু-পরমাণুগুলো তাই মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে না। নিতান্ত ভঙ্গুর না হলে একটা হালকা কঠিন পদার্থের ওপর তুলানামুলক ভারী কোনো কঠিন পদার্থ রাখলেও খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু তরল পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো অনেকটা মুক্তভাবে থাকে। অনেকগুলো তরল পদার্থ একটা পাত্রে যখন রাখা হবে, তখন একটা হিসাব নিশ্চিতভাবে এসে যাবে- কে ওপরে থাকবে আর কে নিচে থাকবে। এখানেও এদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় মহাকর্ষ বল। যে তরলের ঘণত্ব বেশি তার ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব বেশি থাকবে। তাই তুলনামূলক ভারী তরলটা মাহাকর্ষ টানের ফলে পৃথিবীর কাছাকাছি থাকতে চাইবে। অন্যদিকে হালকা তরলের ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাব তুলনামূলক কম হওয়ায় সে ভারী তরলকে নিচের দিকে জায়গা ছেড়ে দেবে। আর নিজে উঠে যাবে ওপরে। এক বালতি পানির ভেতর কিছু মধু ঢেলে দেখলেই এ ব্যাপারটার সত্যতা মিলবে।
ঠিক ওপরের মতোই ঘটনা ঘটে গ্যাসীয় বা বায়বীয় পদার্থে। গ্যাসীয় পদার্থের অণু-পরমাণুগুলো বলতে গেলে প্রায় মুক্তভাবে থাকে। সুতরাং এদের ওপর মহাকর্ষ বলের প্রভাবও থাকে অনে কম। তবুও তো থাকে। আমাদের গোটা বায়ুমণ্ডলটাকে বলা যায় গ্যাসীয় পদার্থের সমুদ্র। সব গ্যাসের ঘনত্ব যেমন সমান নয়, তেমনি সব গ্যাসের পরমাণু সমান ভারী নয়। স্বাভাবিকভাবেই ভারী ও বেশি ঘনত্বের গ্যাসগুলো ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে। হালকা গ্যাসগুলো উঠে যায় ওপরের দিকে।
এখানে আরেকটা প্রশ্ন আসতে পারে, বায়ুমণ্ডলের স্তর যেখানে শেষ, অন্যবস্তুকে নিজের বুকে টেনে আনার ক্ষমতার সীমাও কি সেখানে শেষ ?
না, সেখানে নয়। আমাদের পৃথিবীতে মোট যে গ্যাসীয় পদার্থের পরিমাণ তা দিয়ে মহাকর্ষ সীমার পুরোটাই পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই বায়ুমণ্ডলীয় সীমার বাইরেও মহাকর্ষ ক্ষেত্র রয়েছে। বায়ুর ছড়িয়ে যাওয়া বৈশিষ্ট্যের কথা ভাবলে এই প্রশ্নটা মাথায় এসে যেতে পারে। এ কথা ঠিক, গ্যাসের পরিমাণ যাই হোক, তাকে যখন যে পাত্রে রাখা হয়, তার সবটুকু আয়তন ওই গ্যাস দখল করে। কিন্তু মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে এমন গ্যাস পাত্র হিসেবে ধরলে চলবে না, কারণ গ্যাস পুরো ক্ষেত্রে ছড়িয়ে যেতে চাইলেও মহাকর্ষ বলের টান তা হতে দেয় না।
চাইলেই কি মহাকর্ষ অগ্রাহ্য করা যায়?
অনেক পুরোনো প্রশ্ন। চাইলেই সব কিছু সম্ভব। তবে এজন্য কিছু নিয়ম মানতে হবে। নিউটনের মহাকর্ষ ক্ষেত্রের সাতে বস্তুর গতি জড়িয়ে। একমাত্র গতিই পারে বস্তুকে মহাকর্ষক্ষেত্রকে উপেক্ষা করে বস্তু পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্রের বাইরে নিয়ে যেতে। সেটা কীরকম গতি? এর ব্যাখ্যায় নিউটন টেনেছিলেন একটা কামানের উদাহরণ। তাঁর প্রিন্স্রিপিয়া অব ম্যাথমেটিকা বইটির ৩ নং ভলিউমের ৬ নং পৃষ্ঠায় ছিল বিস্তারতি ব্যাখ্য। সাথে একটা ছবিও ছিল। সেই ছবিটাই এখানে দেওয়া হলো।
ধরাযাক, খুব উঁচু একটা পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপর একটা কামান রাখা হলো। কামান থেকে একটা গোলাটা কিছুদূর গিয়ে মাটিতে পড়ে যাবে। নিউটনের প্রথম সূত্র বলে, বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ নাক করলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির। আর গতিশীল বস্তু সুষম বেগে চলতে থাকবে অনন্তকাল। নিউটনের এই সূত্রটা কাজ করে যেখানে বাহ্যিক বলের প্রভাব নেই, শুধু সেখানেই। কিন্তু ভূপৃষ্ঠে মহাকর্ষ বলের প্রভাব রয়েছে। তাই পাহাড় থেকে ছোড়া কামানের গোলা কামান থেকে সোজা পথে চলতে পারবে না একটানা। পৃথিবরে আকর্ষণে গোলার অভিমূখ ক্রমেই নিচের দিকে বেঁকে যাবে। এবং বাঁকানো পথে মাটিতে আঘাত করবে। এতো প্রথমবার ।
এবার কামানের শক্তি একটু বাড়িয়ে দিন। সেই শক্তি গোলার ওপর বাড়তি বল প্রয়োগ করবে। ফলে গোলাটার গতি প্রথমবারের চেয়ে বেশি হবে। তাই আগের বারের একটু বেশিদূর যেতে পারবে গোলাটি। অর্থাৎ মহাকর্ষ বলের চেয়ে প্রথমবারের তুলনায় বেশিক্ষণ লড়তে পেরেছে দ্বিতীয় গোলাটি। এভাবে আরেকটি বেশি গতি বাড়ালে গোলা আরো বেশি দূর যেতে পারবে। পর্যায়ক্রমে কামানের শক্তি যদি বাড়তেই থাকে, ফলে যদি গোলার ওপর ধ্বাক্কা বলও পর্যায়ক্রমে বাড়ে, তাহলে প্রতিবারই একটু একটু বেশি দূরত্বে গিয়ে পড়বে কামানের গোলা।
পৃথিবী গোলককার। কামানের গোলায় বাঁকানো পথে গিয়ে পড়ছে মাটিতে। ধরা যাক, কামানের শক্তি এতটাই বাড়ানো হলো কামানটি পেরিয়ে গেল হাজার কিলোমিটার। হ্যাঁ, এটা ঠিক কামানের গোলার অত শক্তি নেই। তবে এ যুগের মিসাইলগুলো কিন্তু অতদূর যেতে পারে। নিউটনের পরক্ষীটা ছিল পুরোটাই কাল্পনিক। কিন্তু তাত্ত্বিকভাবে তা অসম্ভব নয়। তাই আমরাও কামানের গোলা দিয়েই পরীক্ষাটাকে আরেকটু এগিয়ে নিই।
ধরা যাক, এবার আরও বেশি ভল প্রয়োগ করে কামানের গোলাটা ছোড়া হলো। এবার সে গিয়ে পড়ল ২০৫০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবীর পরীধির অর্ধেক পথ সে পাড়ি দিয়ে ফেলল বাঁকানো পথে। এবার ধাক্কা বল দ্বিগুন করে ফেলি। তাহলে গোলাটা নিশ্চয়ই আর দ্বিগুন দূরে গিয়ে পড়বে। অর্থাৎ কামান থেকে ৪১ হাজার কিলোমিটিার পথ দূরে গিয়ে পড়বে। কিন্তু পৃথিবী গোল। সর্বোচ্চ পরিধি ৪০০৭৫ কিলোমিটার। সূতরাং কামানের গোলাটা এবার বাঁকানো গোলাকার পথে গোটা পৃথিবীকেই পদক্ষিণ করে ফেলবে।
কিন্তু কামান দাঁড়িয়ে আছে তার চলার পথে। গোলাটা পুরো পৃথিবী ঘুরে কামানের পেছনে এসে ধাক্কা মারবে। পৃথিবী ঘুরে আসতে লাগবে অনেক সময়। ততক্ষণে যদি আমরা কামানটাকে সরিয়ে নিই পাহাড় থেকে, তাহলে কি হবে?
সাদা চোখে দেখলে মনে হবে, কামানের সামনের দিক থেকে ছোড়া গোলা পুরো পৃথিবী ঘুরে এসে কামানের পেছন বারাবর আসতে ৪০০৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু গোলার ওপর যে বল প্রয়োগ করা হয়েছে তাতে কামান সেই পাহাড় পেরিয়ে আরও ৯২৫ কিলোমিটার সামনে এগিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ার কথা। কিন্তু কামানের গোলো সেখানেও পড়বে না। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র মেনে ঘুরতেই থাকবে বার বার। ঠিক যেভাবে চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে, কৃত্রিম উপগ্রহগুলো ঘুরছে পৃথিবীর কক্ষপথে। তেমনিভাবে কামানের গোলাটিরও একটি কক্ষপথ তৈরি হবে পৃথিবীর চারপাশে। অবিরাম সে ঘুরতেই থাকবে, যদি বাতাসের বাধা না থাকে।
বাতাসের বাঁধা নেই। কিন্তু মহাকর্ষের প্রভাব আছে। তাই কামানের গোলাটা ভূপৃষ্ঠে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটাকে ঠেকিয়ে দিচ্ছে গোলার গতিশক্তি। আসলে তখন গোলাটার গতিশক্তির কারণে একটা একটা বল তৈরি হচ্ছে। সেই বলটা চাইছে গোলাটাকে পৃথিবীর আকর্ষণ কাটিয়ে একটা সোজা পথে মহাশূন্যে নিয়ে যেতে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে পৃতিবীর মহাকর্ষ বল। মহকর্ষ বল গোলটাকে টেনে পৃথিবীতে নামাতে চাইছে। সেটাতে সে আগে সফলও হয়েছে, নামাতে পেরেছে কামানের গোলাকে। তখন অবশ্য গোলার গতিশক্তি কম ছিল। কিন্তু এখন আর গোলার গতিশক্তি মহাকর্ষীয় বলকে ছেড়ে কথা কইবে না। শুরু হবে দুই বলের লড়াই। এ লড়াইয়ে দুই বলের শক্তিই সমান। তাই কেউ কাউকে হারাতে পারবে না। কামানের গোলা গতিশক্তি নিয়ে সোজা চলতে চায়, পৃথিবীর মহাকর্ষ তাকে সেই চলায় বাধা দেয়। যেহেতু দুটোরই শক্তি সমান, তাই গোলাও মহাশূন্যে হারিয়ে যেতে পারে না। আবার মহাকর্ষ বলও গোলাকে টেনে মাটিতে নামাতে পারে না। তখন গোলাটা পৃথিবীর কক্ষপথে অবিরাম ঘুরবে।
ধীরে ধীরে কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে। মহাকর্ষ বল অজেয় নয়। যত বেশি বলে কামান গোলা ছুড়ছে, গোলার গতি তত বাড়ছে, পৃথিবীর মহাকর্ষ বলকে তত বেশি পরাস্ত করে গোলা দূরে সরে যেতে পারছে। তারপর গোলা যখন একটা নির্দিষ্ট গতি লাভ করছে তখন মহাকর্ষ আর গোলার শক্তি সমান হচ্ছে।
কিন্তু এমন কি হতে পারে না, এই যুদ্ধে গোলা জিতে যাবে!
নিশ্চয়ই পারে। পাঠকদের বুঝতে বাকি নেই, সেটা পারে একমাত্র গতি বাড়িয়েই। হ্যাঁ, গোলার গতি একটা সময় এমন হতে পারে যখন পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের আর সাধ্য নেই গোলাকে আটকে রাখে। তখন গোলাটা সোজা সেই গতিতে ছিটকে চলে যাবে মহাশূন্যের গহীনে।
নূন্যতম যে বেগে চললে গোলাটা মহাশূন্যে হারিয়ে যাবে, সেটাই হলো পৃথিবীর মুক্তিবেগ। গোলার বেগ যদি সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার হয়, তাহলে সেটা পৃথিবীর মহাকর্ষীয় বলের বাঁধন ছিঁড়ে মহাশূন্যে হারিয়ে যাবে। কিন্তু কামানের সাধ্য নেই অত বেগে গোলা ছোড়ার। নিউটনের সময় কামানই ছিল গোলা নিক্ষেপের মোক্ষম হাতিয়ার। এরচেয়ে ভালো নিক্ষেপক আর ছিল না। কিন্তু মানুষ থেমে থাকে না, বিজ্ঞানের সাথে প্রযুক্তিকেও এগিয়ে নেয় সমান তালে। বিংশ শতাব্দীতেই রকেট এসেছে। এই রকেটের কতই না ব্যবহার। যুদ্ধক্ষেত্রে ছোট্ট গোলা ছুঁড়তে কিংবা দূরদেশে মিসাইল দিয়ে আঘাত হানতে যেমন রকেট করিৎকর্মা, মহাশূন্যযানগুলো পৃথিবীর বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে রকেটের সাহায্যে। মানুষ যেদিন চাঁদে মহাকাশযান পাঠালো, সেদিনই নিউটনের সেই কামানগোলা পরীক্ষার সত্যিকারের প্রমাণ পাওয়া গেল। পৃথিবীর মুক্তবেগের চেয়ে বেশি বেগে রকেট উৎক্ষেণ করা হলো। সেই রকেট মহাকাশযানকে বয়ে নিয়ে গেল পৃথিবীর মহাকর্ষ শক্তিকে হারিয়ে দিয়ে।
মুক্তিবেগের ব্যাপার-স্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বস্তুর ভরের। যে বস্তুর ভর যত বেশি তার মুক্তি বেগও ততবেশি। সূর্যের কথাই ধরা যাক, সূর্যের মুক্তিবেগ সেকেন্ডে ৬১৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ পৃথিবীখে যদি সূর্যের আকর্ষণ বল কাটিয়ে মহাশূন্যে ছিটকে যেতে হয়, তাহলে এর বেগ হতে ৬১৭ কিলোমিটারের বেশি।
ব্ল্যাকহোলের ব্যাখ্যায় নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব বেশি কাজের নয়। তবু মুক্তিবেগটা দরকার হবে। তাই এটাকে ভালো করে মনে রাখুন। সময়মতো মুক্তিবেগের ক্যারিশমা জানাব।
সংগ্রহঃ ইন্টারনেট
বি.দ্রঃ এই পোস্টে ব্যবহৃত সবগুলো ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন