শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে চাইলে আপনাকে যে বইগুলো একবার হলেও পড়তে হবে

বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অন্যতম দুঃখ- নিজ চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখতে না পাওয়া। বড়দের মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠা প্রজন্মটির এই আফসোস তো দূর করা সম্ভব নয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একটি ঘটনা ধীরে ধীরে পরিণত হয় তথ্যে, গল্পে। আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তো কোনো একক ঘটনা নয়, এ যেন এক মহাকাব্য। ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিরা যদি অতীতের গর্বের কথা না জানে, তবে কেমন করে তারা সুন্দর একটি আগামী রচনা করবে? এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার গল্প নিরপেক্ষভাবে বর্তমান তরুণ সমাজের সামনে তুলে ধরার এক অনন্য মাধ্যম বই। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে কেমন ছিল বাঙালিদের জীবন, বই পড়েও তা হয়তো অনেকাংশেই উপলব্ধি করতে পারবে তারা। স্বাধীনতা যুদ্ধকে যারা আজও ‘গণ্ডগোল’ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, তাদের মুখের উপর বীর বাঙালির সাহসিকতার জয়গাঁথা বর্ণনা করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় বই থেকেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস যেমন লিখে শেষ করে যাবে না, ঠিক তেমনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত গল্প, কবিতা, উপন্যাস, বাস্তব অভিজ্ঞতার সংখ্যাও গুণে শেষ করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিছু বই নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের আয়োজন।

একাত্তরের দিনগুলি

একাত্তরের দিনগুলি
মা যখন চা-নাস্তার ব্যবস্থা করছেন, ছেলে তখন ঐ একই ঘরে বসে গেরিলা পরিকল্পনা করছে। হাসিমুখে জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করছে ছেলে, মা তাকে যুদ্ধে যাওয়ার উৎসাহ দিচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে বেশ কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে একজন শহীদ জননীর ব্যক্তিগত দিনলিপি থেকে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে শুরু হয় দিনলিপিটি, শেষ হয় সে বছরেরই ১৭ ডিসেম্বর। মাতৃস্নেহের চেয়ে দেশপ্রেমকে বড় করে দেখা দৃঢ়চেতা মুক্তিকামী এই নারী নিজের ছেলেকে প্রধান চরিত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন এই বইয়ে। একজন মায়ের কঠিন আত্মত্যাগের কাহিনী এটি। চাইলেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে ছেলের জীবন ভিক্ষা চাইতে পারতেন তিনি, কিন্তু তাতে খর্ব হতো তার ছেলের গর্ব। চোখের সামনে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকা ছেলেকে দেখেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে মাথা না নোয়ানোর জন্য কী কঠোর ব্যক্তিত্ব থাকা উচিৎ, তা পরিষ্কার বোঝা যায় এই বইটি থেকে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা শহরের সামগ্রিক অবস্থা এবং গেরিলা তৎপরতা নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণনা করেছেন শহীদ শফি ইমাম রুমীর মা, বাংলাদেশী কথাসাহিত্যিক জাহানারা ইমাম, বইয়ের নাম ‘একাত্তরের দিনগুলি’। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এরপর পাঠকদের চাহিদায় আরও বেশ কয়েকটি মুদ্রণ বের হয় বইটির, পাওয়া যাবে সন্ধানী প্রকাশনীতে।

জোছনা ও জননীর গল্প

জোছনা ও জননীর গল্প
‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসে বাংলাদেশের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার বাস্তব অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাকে চমৎকার ভাষায় বর্ণনা করেছেন তরুণ প্রজন্মের কাছে। বইটির ভূমিকাতেই হুমায়ূন আহমেদ পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ কোনো ইতিহাসের বই নয়। কিন্তু এটি এমন একটি উপন্যাস যে উপন্যাসের কাহিনীকে সাজানো হয়েছে দেশমাতার ঋণ শোধ করার জন্য। একজন লেখক হিসেবে লেখাকে পণ্য বানানোর জন্য নয়, একজন লেখক হিসেবে মানুষের অনুভূতি বা সংবেদনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে বইয়ের পসারের জন্যও তিনি এ উপন্যাসটি লেখেননি। তাই উপন্যাস হলেও হুমায়ূন চেষ্টা করেছেন ইতিহাসের একেবারে কাছাকাছি থাকার। সে অর্থে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’কে উপন্যাস আদলে লেখা ইতিহাসের দলিল বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।
লেখকের নিজের জীবনের এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির অভিজ্ঞতাও উঠে এসেছে এখানে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ তৎকালীন উল্লেখযোগ্য কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তির কোথাও এখানে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একুশে বইমেলায় অন্যপ্রকাশ থেকে বের হয় এই উপন্যাসটি। ২০০৮ সালে উপন্যাসটির উপর ভিত্তি করে বিটিভিতে নাটক নির্মাণের কাজও শুরু করেন লেখক এবং নাট্যনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ।

একাত্তরের চিঠি


একাত্তরের চিঠি
তাং: ২৩ – ০৫ – ১৯৭১
জনাব আব্বাজান,
আজ আমি চলে যাচ্ছি। জানি না কোথায় যাচ্ছি। শুধু এইটুকু জানি, বাংলাদেশের একজন তেজোদীপ্ত বীর স্বাধীনতাকামী সন্তান হিসেবে যেখানে যাওয়া দরকার আমি সেখানেই যাচ্ছি। বাংলার বুকে বর্গী নেমেছে। বাংলার নিরীহ জনতার উপর নরপিশাচ রক্তপিপাসু পাকসৈন্যরা যে অকথ্য বর্বর অত্যাচার আর পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে, তা জানা সত্ত্বেও আমি বিগত এক মাস পচিঁশ দিন যাবৎ ঘরের মধ্যে বিলাসব্যসনে মত্ত থেকে যে ক্ষমাহীন অপরাধ করেছি, আজ সেই অপরাধের পায়শ্চিত্ত করার জন্য যাত্রা শুরু করলাম। সমগ্র বাঙ্গালী যেন আমাকে ক্ষমা করতে পারেন। আপনি হয়ত দুঃখ পাবেন। দুঃখ পাওয়ারই কথা। যে সন্তানকে দীর্ঘ ষোল বছর ধরে তিল তিল করে হাতে কলমে মানুষ করেছেন, যে ছেলে আপনার বুকে বারবার শনি কৃপণের আঘাত হেনেছে, যে ছেলে আপনাকে একটু শান্তি দিতে পারেনি, অথচ আপনি আপনার সেই অবাধ্য দামাল ছেলেকে বারংবার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন, যার সমস্ত অপরাধ আপনি সীমাহীন মহানুভবতার সঙ্গে ক্ষমা করেছেন। আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন সম্ভবত একটি মাত্র কারণে যে, আপনার বুকে পুত্রবাৎসল্যের রয়েছে প্রবল আকর্ষন।
পত্র লেখকের নাম ফারুক, পুরোনাম শহীদ মুক্তিযুদ্ধা আমানউল্লাহ চৌধুরী ফারুক। চট্টগ্রাম সিটি কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার বামনী বাজারের দক্ষিণে বেড়িবাঁধের ওপর পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এই যুদ্ধে আরও চার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এমন আরও ৮১টি চিঠি নিয়ে মোট ৮২টি চিঠির একটি সংকলন নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘একাত্তরের চিঠি’। ২০০৯ সালের মার্চে প্রথম আলো ও গ্রামীণফোনের যৌথ উদ্যোগে চিঠিগুলো সংগ্রহ করে প্রকাশ করে প্রথমা প্রকাশন।

রাইফেল, রোটি, আওরাত

রাইফেল, রোটি, আওরাত
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ আনোয়ার পাশার উপন্যাস ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’। জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লিখেছিলেন ডায়েরি, আর ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ই একমাত্র উপন্যাস যা যুদ্ধ চলাকালে লেখা হয়। পাকিস্তানিদের রাইফেলের সামনে হুমকির মুখে পড়ে যায় আমাদের অস্তিত্ব, রোটি বা খাদ্যের সংকটে ছটফট করতে থাকে পুরো বাঙালি সমাজ আর আওরাত বলতে বোঝানো হয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারানো প্রায় তিন লক্ষ নারীকে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু করে জুন মাস পর্যন্ত বইটি লেখেন আনোয়ার পাশা।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আরও অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর সাথে নিহত হন আনোয়ার পাশাও। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই বইটিতে লেখক ২৫ মার্চের কালরাত্রি থেকে পরের তিন দিনের উপাখ্যান লিখে রেখে গেছেন। উপন্যাসের প্রতি পাতায় যেন মিশে রয়েছে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।

আমার বন্ধু রাশেদ

আমার বন্ধু রাশেদ
ছোটদের জন্য বই লেখার ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। মুক্তিযুদ্ধের বেলায়ও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া এক কিশোর রাশেদ, দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যে ব্যাকুল আবেদন তার হৃদয়ে ফুটে উঠেছিল তা যেন যুদ্ধের সময়ে সামগ্রিক অর্থে কিশোরমনকেই তুলে ধরে। সমবয়সীরা যখন যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেকটাই অসচেতন, ঠিক তখনই যেন তাদের শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আন্দোলনের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা প্রকাশ করে রাশেদ। এই উপন্যাসটি থেকে ২০১১ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম।
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় ‘আমার বন্ধু রাশেদ’। বন্ধু ইবুর জবানিতে পুরো গল্পটিতে মর্মস্পর্শী এক আবহ সৃষ্টির পিছনে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন লেখক।

ক্রাচের কর্নেল

 ক্রাচের কর্নেল
বাংলাদেশের রাজনীতির ধোঁয়াশায় ঘেরা একটি নাম কর্নেল তাহের। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চারণ করে গেছেন, নিঃশঙ্ক জীবনের চেয়ে বড় কোনো সম্পদ নেই। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে একেবারে ঢেলে সাজানোর কর্মসূচী নেয়া এই ব্যক্তিত্বকে ঘিরে তরুণদের মধ্যে আলাদা একটি আগ্রহ আছে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক চরিত্রনির্ভর উপন্যাসের সংখ্যা এমনিতেই অনেক কম। তার উপর কর্নেল তাহেরের ব্যক্তিগত জীবন, সামরিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান এবং তার ফাঁসির নামে প্রহসনের পুরো ব্যাপারটি লেখক এতো চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা সব শ্রেণীর পাঠককেই মুগ্ধ করবে। আর সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে শক্তিশালী গদ্যকার হিসেবে ইতোমধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন শাহাদুজ্জামান। তার লেখনীতে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ‘৭১-এর দুর্বিষহ দিনগুলোর চিত্র।
২০০৯ সালের একুশে বইমেলার শেষদিকে ‘ক্রাচের কর্নেল ’উপন্যাসটি প্রকাশ করে মাওলা ব্রাদার্স। ২০১৭ সালের বইমেলাতেও মাওলা ব্রাদার্সের সর্বাধিক বিক্রিত বই ছিল বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই উপন্যাসটি।

মা

 মা
সত্তরের দশকে ঢাকার অন্যতম প্রভাবশালী এক বিত্তবানের স্ত্রী ছিলেন আসিয়া খাতুন। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন এই নারী স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে না পেরে একমাত্র সন্তান মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। বিলাসিতার সাম্রাজ্য পিছে ফেলে রেখে এসে গড়ে তোলেন নিজের যুদ্ধক্ষেত্র। প্রতি পদে সংগ্রাম করে আজাদকে লেখাপড়া শিখিয়ে করে তোলেন মানুষের মতো মানুষ। সেই সন্তান যখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা দলে যোগ দেয়, মা তখন ছায়াসঙ্গী হয়ে তাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যান প্রতি মুহূর্তে। পাকিস্তানিদের প্রবল অত্যাচারের মুখেও ছেলে যেন মুক্তিযোদ্ধাদের নাম না বলে, সে ব্যাপারে সদা সতর্ক ছিলেন তিনি।
মৃত্যুর আগে ছেলেকে একবার চোখের দেখাও দেখতে পারেননি তিনি। ছেলে ভাত খেতে চেয়েছিল মায়ের কাছে। সেই ভাত খাওয়াতে পারেননি বলে জীবনভর আর ভাতই স্পর্শ করেননি তিনি। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক আনিসুল হক মহিয়সী এই নারীর কথা জানতে পারেন মুক্তিযোদ্ধা নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কাছ থেকে। শহীদ আজাদ ও তার মায়ের গল্প নিয়েই সত্য ঘটনা অবলম্বনে তিনি লিখে ফেলেন ‘মা’ উপন্যাসটি।
২০০৪ সালে সময় প্রকাশন থেকে বের হওয়া এই বইটি নয়া দিল্লীতে ‘Freedom’s Mother’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।

পাক সার জমিন সাদ বাদ

 পাক সার জমিন সাদ বাদ

 


ভালো বই বলতে যদি এমন কোনো বই বোঝানো হয়, যা পাঠককে খুশি করে বা ঘোরের ভেতরে ঠেলে দেয়, তবে সেই অর্থে এটি মোটেই কোনো ভালো বই না। ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ এমন একটি বই, যা পাঠককে শুধু চাবুকের মতো আঘাত করে। একজন রাজাকার এবং সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির মনোজগতকে যদি হুবহু কাগজে ছাপানো যেত, তবে এই বইটিই হতো সেই দলিল। এই বইতে একজন ধর্মান্ধের স্বগতোক্তি একজন রাজাকার সমর্থককেও আতঙ্কিত করে, তাই তাকে বাধ্য হতে হয় লেখকের শরীর ছিন্নভিন্ন করে সেই ত্রাসকে চাপা দিতে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রাক্কালে বইটির প্রতিটি অক্ষর যেন একে একে জ্যান্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বইটি সম্পর্কে পাঠকরা ঠিক এভাবেই তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন একদম শুরু থেকেই। বাংলাদেশের অন্যতম প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ এই উপন্যাসটির কারণে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতাকারী  গোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে এটি রচিত হয়। এ কারণে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী আমির এবং প্রাক্তন সংসদ সদস্য দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জাতীয় সংসদে এই বইয়ের বিরুদ্ধে হুমকিও দিয়েছিল।
২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আগামী প্রকাশনীর ব্যানারে ছাপা হয় এই উপন্যাসটি।

চিলেকোঠার সেপাই

চিলেকোঠার সেপাই
ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও আন্দোলনের জীবন্ত সাক্ষী ‘চিলেকোঠার সেপাই’। উপন্যাসটির প্লট মূলত উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে। গল্পের প্রধান চরিত্র রঞ্জু ওরফে ওসমান, ওসমানের বন্ধু আনোয়ার আর আলতাফ। ঘুরেফিরে চলে আসে রিকশাচালক বস্তির বাসিন্দা খিজিরের কথাও। আনোয়ার বামপন্থী আর আলতাফ ডানপন্থী। আনোয়ার আর আলতাফের কথোপকথনের মাধ্যমে লেখক অনেক জটিল রাজনৈতিক জটিলতাকে মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। শ্রমজীবী জনসাধারণ কীভাবে উনসত্তরের আন্দোলন পরবর্তী সময়টিতে প্রতারিত এবং বঞ্চিত হলো, রাজনীতির ময়দান থেকে বামপন্থীরা কীভাবে অপসারিত হলো, আওয়ামী লীগ কীভাবে প্রধান শক্তি হয়ে উঠলো, উপন্যাসটির উপজীব্য সেই ঐতিহাসিক সময়টুকুই। বাংলাদেশের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার প্রথম উপন্যাসেই বাজিমাত করেছিলেন তৎকালীন জনসাধারণের মনোবিশ্লেষণে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে।
১৯৮৬ সালের অক্টোবর মাসে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় ‘চিলেকোঠার সেপাই’। ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত আখতারুজ্জামান ‘ইলিয়াস রচনাসমগ্র-২’ এও উপন্যাসটি সংকলিত হয়।

অলাতচক্র

অলাতচক্র
মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত লেখক দানিয়েল ও ক্যান্সারে আক্রান্ত তাইয়্যেবার মধ্যকার অস্ফুট ভালবাসা, মানসিক টানাপোড়েন, যুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘অলাতচক্র’। বাংলাদেশের যুদ্ধ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির এত ভিন্নতা খুব সম্ভবত আর কোথাও এভাবে আসে নি। পাঠকদের মতে বইটির সবচেয়ে ভালো দিক হলো মুক্তিযুদ্ধকালীন মনস্তত্ত্ব ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ। ঘটনা ঘটে যাবার পর তাকে হাজারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু চলমান সময়ের ব্যাখ্যাই ঘটনার গতিপ্রকৃতি সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝাতে পারে। এই উপন্যাসে সেই সময়ের কিছু ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র আহমদ ছফা।
শুরুতে বইটি ছাপা হয়েছিল আত্মজীবনী হিসেবে, ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক ‘নিপুণ’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে উপন্যাসটি। ছফার চোখ দিয়েই যেন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি দেখানো হয়, জানানো হয় বইটিতে। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে মুক্তধারা থেকে উপন্যাস আকারে পরিমার্জিত করে বের করা হয় বইটি। ‘আহমদ ছফা রচনাবলী’তে পাওয়া যাবে উপন্যাসটি।

একাত্তরের যীশু

একাত্তরের যীশু
গল্প পড়ে যারা ভুলে যান, তারা একবার ‘একাত্তরের যীশু’ উপন্যাসটি পড়ে দেখতে পারেন। ডেসমন্ডের চোখের পানি, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রুশবিদ্ধ করে রাখার কাহিনী কিংবা সেই ফুটফুটে বোবা মেয়েটির লাশের কথা বোধহয় গল্পটি কখনো ভুলতে দেবে না। জেলেপাড়ার এক খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকার গল্প এটি, যেখানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীরা চালিয়েছে দুর্বিষহ অত্যাচার। বাইবেল আর যীশুর গল্প শোনানো পাদ্রীদের মেরে ফেলে তারা, ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় গির্জাগুলো। অথচ দেশ স্বাধীন করতে কী অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন ফাদার-সিস্টাররা মিলে, তা নিয়ে বোধহয় বাংলার সাহিত্য জগতে এমন কাজ আর খুব বেশি দেখা যায় না। লেখক শাহরিয়ার কবির স্বল্প ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তিকামী মানুষের আহাজারি আর সংগ্রামের চালচিত্র।
নিউ শিখা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ৭২ পৃষ্ঠার উপন্যাস ‘একাত্তরের যীশু’। উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও।

হাঙর নদী গ্রেনেড

হাঙর নদী গ্রেনেড
 গ্রামের চঞ্চল এক কিশোরীর গল্প এটি, নাম তার বুড়ি। সবার আদরের সেই মেয়েটির কম বয়সে বিয়ে হয় নিজের চেয়ে বয়সে অনেক বড় এক লোক গফুরের সাথে। গফুরের দুটি ছেলে ছিল, সলীম আর কলীম। বুড়ি তার নিজের গর্ভে জন্ম দেয় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী এক সন্তানের, যাকে ঘিরেই ছিল তার পুরো পৃথিবী। আদর করে তার নাম রাখে ‘রইস’। এরই মধ্যে দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে, সলীম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভাই সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান না দেয়ার অপরাধে বুড়ির চোখের সামনে কলীমকে গুলি করে মেরে ফেলে পাকবাহিনী। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা যখন বুড়ির বাড়িতে আশ্রয় নেয় আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের খুঁজতে আসে, তখন নিজের সবচেয়ে আদরের ধন রইসকে ঠেলে দেয় পাকসেনাদের বন্দুকের মুখে আর জীবন বাঁচায় হাজারো সলীমের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের এক মায়ের সত্য ঘটনা অবলম্বনে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন রচনা করেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি। যে কারো চোখে পানি এনে দিতে বাধ্য করবে কালজয়ী এই উপন্যাসটি।
১৯৭৬ সালে অনন্যা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই পোস্টে ব্যবহৃত সবগুলো ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন